
প্রতিবেদক: বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রথম দিনেই দেখা গেল, ডলারের দরে তেমন কোনো হেরফের হয়নি। আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স লেনদেনে ডলারের দর ছিল আগের মতোই। ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে এবং নগদ ডলারে লেনদেনেও দরের পরিবর্তন চোখে পড়েনি। তবে খোলাবাজার বা মানি এক্সচেঞ্জে ডলারের দর সামান্য বেড়েছে।
গতকাল সাতটি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম দিন সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছে। তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে তদারকি করছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট দর ঠিক করে দেয়নি, তবে বলা হয়েছে—প্রকাশিত ‘রেফারেন্স রেট’ থেকে বড় অমিল হলে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কোনো ব্যাংকে সংকট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনমতো ডলার সরবরাহ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় ডলারের দরে বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। রিজার্ভও সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে। আইএমএফের সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী আগামী জুনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে ৩৫০ কোটি ডলার কম সুদে পাওয়া যাবে, যা রিজার্ভকে আরও শক্তিশালী করবে।
অন্যদিকে খোলাবাজারে ডলারের দর বেড়ে সর্বোচ্চ ১২৬ টাকা হয়েছে। মানিচেঞ্জাররা কিনেছেন ১২৫.৫০ থেকে ১২৫.৬০ টাকায় এবং বিক্রি করেছেন ১২৬ টাকায়। যদিও কয়েকদিন ধরেই এই দরেই বেচাকেনা হচ্ছিল। ব্যাংকগুলোর কাছে বর্তমানে নগদ ৫ কোটি ডলার মজুত রয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে সর্বোচ্চ। তবে লেনদেনের বড় অংশ নগদ নয়, তাই এই নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন দিনে দু’বার গড় দরের ভিত্তিতে রেফারেন্স রেট প্রকাশ করছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ছিল ১২১.৯৫ টাকা এবং বিকেলে তা বেড়ে হয় ১২১.৯৯ টাকা। গত এক মাসে রেফারেন্স রেটে বড় পরিবর্তন দেখা যায়নি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বাজারভিত্তিক বিনিময় হারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, কোনো ব্যাংক যেন অপ্রয়োজনে বেশি দরে ডলার বেচাকেনা না করে, এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদি সবাই প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার কেনাবেচা করে, তাহলে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলো একে অন্যের কাছ থেকে ১২২ টাকায় ডলার কিনেছে। মোট কেনাবেচা হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ডলার। রেমিট্যান্সের ডলার ১২১ থেকে ১২১.৭০ টাকা দরে কিনে আমদানিকারকদের কাছে ১২২ থেকে ১২২.৭০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। নগদ ডলার ১২২ টাকায় কিনে ১২৩ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা গত কিছুদিন ধরে চলমান ছিল।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মৌখিকভাবে সর্বোচ্চ ১২২ টাকায় ডলার কিনে ১২৩ টাকায় বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিল। এখন সেটি আর নেই। তবে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করে বাজারে হস্তক্ষেপ করবে।
এক বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান জানান, এখন ব্যাংকগুলো দিনে দু’বার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিপোর্ট জমা দিচ্ছে। কোনো ব্যতিক্রম ঘটলে তা দ্রুতই ধরা পড়বে। তাই এখন সবাই সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
বিনিময় হার বাজারভিত্তিক না করায় আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দুটি কিস্তি ঝুলে ছিল। আইএমএফের শর্ত না মানলে অন্যান্য সংস্থার ঋণও বন্ধ হয়ে যেত। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, আগামী জুনের মধ্যে আইএমএফের ১৩০ কোটি এবং অন্যান্য সংস্থার ২২০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে।
২০২৩ সালে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি শুরুর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ক্রলিং পেগ’ নামে একটি পদ্ধতি চালু করেছিল। তখন একবারে ডলারের দর ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয় এবং সীমিত ওঠানামার সুযোগ দেওয়া হয়। পরে এই সীমা আড়াই শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। জানুয়ারিতে মৌখিকভাবে বলা হয় ১২২ টাকায় কেনা ও ১২৩ টাকায় বিক্রি করা যাবে।
বাজারভিত্তিক সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে গভর্নর ব্যাংকগুলোর এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি দুবাইভিত্তিক এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর ওপর সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এবং জানান, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবাহে ইতিবাচক পরিস্থিতি রয়েছে, বিদেশি কোনো বকেয়া নেই, এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে সহায়তা দেবে।