বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র নয়, ব্যাংকের ওপর বাড়ছে নির্ভরতা

প্রতিবেদক: চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। নিট ঋণের অর্থ হলো—মোট বিক্রি থেকে গ্রাহকদের আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তিতে বা মেয়াদ শেষের আগে নগদায়নের বিপরীতে পরিশোধ করে যে অর্থ থাকে, সেটাই সরকারের জন্য প্রকৃত ঋণ। কিন্তু জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, এই লক্ষ্য পূরণ দূরের কথা, বরং এ খাত থেকে সরকারের ঋণ হতে যাচ্ছে ঋণাত্মক ১২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, বাজেট ঘাটতি মেটাতে এখানে সরকারের কোনো সহায়তা না মিললেও উল্টো বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হবে।

প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার। একই সময়ে গ্রাহকদের কাছে পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ফলে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ধারণা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে নিট ঋণ দাঁড়াবে ঋণাত্মক ১২ হাজার ২২ কোটি টাকা, যা বাজেট ঘাটতির ভার আরও বাড়াবে।

মূলত দীর্ঘদিনের মূল্যস্ফীতি, আমানতের সুদহার বৃদ্ধি এবং সঞ্চয়পত্রের চেয়ে অন্যান্য বিনিয়োগ মাধ্যম বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠায় জনগণের মধ্যে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার প্রবণতা বেড়েছে। একই সঙ্গে নতুন বিনিয়োগ কমে গেছে। অথচ সঞ্চয়পত্রে সুদহার তুলনামূলক বেশি হওয়া সত্ত্বেও এ খাত থেকে প্রত্যাশিত ঋণ পাচ্ছে না সরকার।

সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় মানুষ নিজেদের সঞ্চয়পত্র ভেঙে ফেলছে। ব্যাংকে এখন আমানতের সুদহার অনেকটাই বেড়েছে, ফলে সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহ কমছে। অথচ এই খাত থেকেই আগে সরকার বাজেট ঘাটতির বড় একটি অংশ মেটাত। এখন সঞ্চয়পত্র থেকে আয় না এলে ব্যাংক খাত থেকে আরও বেশি ঋণ নিতে হবে, যা বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে দেশি উৎসের বড় একটি অংশ আসে ব্যাংক খাত থেকে। এখন সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ ঋণাত্মক হওয়ায় ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বাড়বে, যা দেশের আর্থিক খাতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

সরকার বিক্রি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—সুদহার বাড়ানো, অনলাইন লেনদেন ব্যবস্থা চালু, প্রিমিয়াম হারে সুদ সুবিধা, মেয়াদ শেষে পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা, পেনশনারদের জন্য মাসিক মুনাফা, এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ বিনিয়োগ সুবিধা। তবে বাস্তবতা হলো—এসব সুবিধা সত্ত্বেও সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার প্রবণতা এবং বিনিয়োগে অনীহা কমেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডে সুদহার ১১.৩৬ শতাংশ এবং দুই বছর মেয়াদি বন্ডে ছিল প্রায় ১২.৫ শতাংশ, যা সঞ্চয়পত্রের চেয়ে বেশি। তাছাড়া সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে কর দিতে হলেও ট্রেজারি বিল বা বন্ডে কর দিতে হয় না। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে ঝুঁকছেন। এতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির হার আরও কমে যাচ্ছে।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১১টি জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মধ্যে ৯টির লেনদেন কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে পাঁচ ধরনের সঞ্চয় স্কিমের সুদহার বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১ শতাংশ করে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে প্রথম স্ল্যাবে সাড়ে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত প্রিমিয়াম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুনর্বিনিয়োগের হার কম, বরং মেয়াদপূর্তির আগেই ভাঙিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বেশি।

সবশেষে বলা যায়, সঞ্চয়পত্র খাতে নিট ঋণ ঋণাত্মক হয়ে যাওয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এতে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে এবং ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাবে। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।