
প্রতিবেদক: বাজেট মূলত একটি ব্যয় ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা। একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাবকেই বাজেট বলা হয়, যার উদ্দেশ্য পুরো রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও জনকল্যাণ। সরকারের নানা খাতে ব্যয় করতে হয়—কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি। তাই নির্দিষ্ট একটি অর্থবছরের জন্য সরকার কোথায় কত ব্যয় করবে, তার পরিকল্পনাই হলো বাজেট।
একজন ব্যক্তিকেও নিজের ও পরিবারের জন্য আয়-ব্যয়ের হিসাব করতে হয়। বাজেটের উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত পর্যায়েও উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তবে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের বাজেটে পার্থক্য আছে। ব্যক্তি আগে আয় বুঝে ব্যয় করেন, রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের পরিকল্পনা করে, পরে আয়ের উৎস খোঁজে। এছাড়া ব্যক্তি সীমিত ঋণ নেন—আত্মীয়, ব্যাংক বা এনজিও থেকে, অথচ সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করে। ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে দেউলিয়া হতে পারেন, সরকার কখনোই সরাসরি দেউলিয়া হয় না, বরং দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ রাখে।
রাষ্ট্রের আয়ের উৎস তিন ভাগে ভাগ করা যায়—প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর ও করবহির্ভূত আয়। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে আছে আয়কর, করপোরেট কর, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব ইত্যাদি। পরোক্ষ কর হিসেবে রয়েছে ভ্যাট, শুল্ক, আবগারি ইত্যাদি। কর ছাড়া আরও আছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা, সুদ, জরিমানা, ইজারা, টোল থেকে আয়। সব মিলে রাষ্ট্র বাজেটে সম্ভাব্য আয় নির্ধারণ করে, এবং সেখান থেকে চলতি ব্যয় ও উন্নয়ন খাতে অর্থ ব্যয় করে।
রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় সমান হলে তাকে সুষম বাজেট বলা হয়। তবে অধিকাংশ সময়ই বাজেট ঘাটতি হয়। ঘাটতি বাজেট তখন হয়, যখন ব্যয় বেশি ও আয় কম। আবার যদি আয় বেশি হয় তবে তা হয় উদ্বৃত্ত বাজেট। ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেয়। যদিও সরকার দেউলিয়া হয় না সহজে, কিন্তু ঋণের বোঝা বাড়ে। উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সংকট এবং বাংলাদেশের উচ্চ সুদ পরিশোধ উল্লেখযোগ্য।
সরকারের ব্যয় প্রধানত দুটি ভাগে—রাজস্ব ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়। রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে পড়ে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, ভর্তুকি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থ দিয়ে নির্মাণ হয় রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাসপাতাল, স্কুলসহ নানা অবকাঠামো। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে এই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।
বাংলাদেশ শুরু থেকেই ঘাটতি বাজেট করে আসছে। ঘাটতি পূরণে সরকার দুটি উৎস ব্যবহার করে—বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ। বৈদেশিক উৎস থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেওয়া অর্থনীতির জন্য তুলনামূলকভাবে ভালো। তবে শর্ত থাকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থ নেয়। ব্যাংক থেকে বেশি নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়, আর সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিতে হলে বেশি সুদ দিতে হয়, যা ভবিষ্যৎ বাজেটের ওপর চাপ ফেলে। সরকার চাইলে টাকা ছাপিয়েও ঘাটতি পূরণ করতে পারে, তবে এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
উন্নত দেশগুলো সাধারণত সুষম বাজেট করে থাকে। তবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না হলে ঘাটতি বাজেট গ্রহণযোগ্য। এখনকার ধারণা অনুযায়ী, অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাজেট তৈরি করাই উত্তম। বাংলাদেশের মতো দেশে সীমিত ঘাটতি—জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে—গ্রহণযোগ্য বলে ধরা হয়। ঘাটতির ফলে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার হয় এবং অর্থনীতি সক্রিয় থাকে।
সাধারণ মানুষের বাজেট সম্পর্কে সচেতন হওয়া দরকার। তারা নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে পারেন।
মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য: কর বা শুল্ক বাড়লে পণ্যের দাম বাড়তে পারে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি জীবনে বড় প্রভাব ফেলে।
করনীতি ও করের বোঝা: নতুন কর বা করের হার বৃদ্ধিতে ব্যয় বাড়ে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর প্রভাব পড়ে।
কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ: বাজেটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উদ্যোগ থাকলে সেটি সহায়ক হবে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ: এই দুই খাতে বাজেট বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের মৌলিক সেবা উন্নত হবে।
করমুক্ত আয়ের সীমা: মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলে স্বস্তি মিলবে।
উন্নয়ন প্রকল্প: স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন রাস্তা, সেতু, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদিতে বরাদ্দ থাকলে মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে।
ঋণ ও ঘাটতি: ঘাটতি মেটাতে বেশি ঋণ নেওয়া হলে ভবিষ্যতে সরকারের ওপর সুদ পরিশোধের চাপ বাড়ে।
স্বচ্ছতা: বাজেটের হিসাব স্বচ্ছ হলে নাগরিকেরা বুঝতে পারেন করের টাকা কোথায় যাচ্ছে, এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।