বাজেট সংকটে সরকার: ভ্যাট-শুল্ক বৃদ্ধি

অনলাইন ডেক্স:বাজেটের অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে বিকল্প পথ খুঁজছে সরকার। এ জন্য শুল্ক ও কর বাড়িয়ে সহজ উপায়ে রাজস্ব সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গত বৃহস্পতিবার শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে জনগণের ওপর বাড়তি ভ্যাটের বোঝা চাপানো হচ্ছে।

সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার বাড়িয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনতে আরও আগ্রহী হবেন বলে আশা করছে সরকার। অন্যদিকে, ব্যাংক খাতের দুর্বল অবস্থার কারণে সেখান থেকে বাড়তি ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

সরকার বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে চলতি অর্থবছরে ১৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এর মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ অর্থ হাতে পেয়েছে। সার্বিকভাবে, বাজেট ঘাটতি পূরণে নানা পথে হাঁটতে হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরও বাড়াচ্ছে।

খরচ বৃদ্ধি, আয় স্থবির

চলতি অর্থবছরে সরকারের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা কয়েকগুণ বাড়িয়েছিল। এবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অন্তর্বর্তী সরকার মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সংশোধিত বাজেটে এ বাবদ বরাদ্দ রাখা হতে পারে।

অন্যদিকে, রাজস্ব আয় আশানুরূপ হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সাড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতিতে রয়েছে। এর পাশাপাশি, বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে, যা আগের তুলনায় বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাজেটে অর্থের ঘাটতি রয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। পাশাপাশি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতাও এর জন্য দায়ী। আইএমএফের শর্তমতো শুল্ক-কর বাড়ানোর চাপ সামাল দিতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে।’

সরকারের এসব উদ্যোগ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলছে। একদিকে শুল্ক-কর বৃদ্ধি, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ও আয় হ্রাসের কারণে নাগরিক জীবনে চাপ ক্রমেই বাড়ছে।

অর্থ সংকটে কর শুল্ক বৃদ্ধি: জনজীবনে বাড়তি চাপ

চলমান অর্থ সংকট মোকাবিলায় সরকার কর ও শুল্ক বৃদ্ধি করেছে, তবে এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, এতে জনগণের ভোগান্তি বাড়বে। কর হার বাড়ানোর ফলে আদায় বাড়বে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।” সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বৃদ্ধির মূল কারণও হলো অর্থের জোগান নিশ্চিত করা।

বাজেটের পরিচালন ব্যয় ও উৎস

চলতি অর্থবছরের ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এর বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন–ভাতা এবং দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়। বাকি অর্থ ব্যয় হয় উন্নয়ন প্রকল্পে।

রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুল্ক-কর (এনবিআর) এবং শুল্ক-করবহির্ভূত রাজস্ব অন্তর্ভুক্ত। বাকি ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দেশি-বিদেশি ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

অর্থ সংকট ও অনিশ্চয়তা

অর্থবছরের শুরু থেকেই বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ জোগানে সংকট দেখা দেয়। জুলাই-আগস্ট মাসের রাজনৈতিক আন্দোলন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বাড়তে থাকে। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে প্রতি মাসেই ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই ঘাটতি পূরণে শুল্ক-কর বৃদ্ধি এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের চাপে চলতি অর্থবছরের মাঝপথে ১০০টিরও বেশি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।

জনজীবনে প্রভাব

ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য এই চাপ সমানভাবে প্রযোজ্য।

  • মুঠোফোন সেবার ওপর শুল্ক বৃদ্ধির ফলে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বেড়েছে।
  • পোশাকের দাম বাড়তে পারে, যা সাধারণ জনগণের জন্য আরেকটি বোঝা।
  • রেস্তোরাঁর খাবারের বিল বেড়ে যাওয়ায় খাবারের খরচও বাড়ছে।

সরকারি পরিচালন ব্যয় কমানোর কোনো উপায় না থাকায় জনগণের ওপর করের বোঝা চাপছে। পাশাপাশি, বাজেট সহায়তার জন্য বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধি, রাজস্ব বাড়ানোর চেষ্টা

শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে ১০-১২ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায়ের আশা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ভ্যাট বৃদ্ধির তালিকায় রয়েছে টিস্যু পেপার, মিষ্টি, ওষুধ, এলপি গ্যাস, ফলের রস, ড্রিংক, বিস্কুট, চশমার ফ্রেম, সিগারেটসহ অন্যান্য পণ্য।

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণে এই শুল্ক-কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় পেতে শুল্ক-কর বৃদ্ধির শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ।

রাজস্ব ঘাটতি ও সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে উদ্যোগ

এনবিআরকে চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হলেও, প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি ৪২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা।

এদিকে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় সরকার মুনাফার হার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন হার অনুযায়ী সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১২ দশমিক ২৫ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বা ৩১ শতাংশ কমেছে। অক্টোবর থেকে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

বিদেশি ঋণ ও পরিশোধের ভার

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ঋণ ছাড়ের চেয়ে ঋণের সুদাসল পরিশোধের পরিমাণ বেশি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, গত জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১৫৪ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে। একই সময়ে ১৭১ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে নিট বিদেশি ঋণ প্রাপ্তি নেতিবাচক অবস্থায় রয়েছে।

বিদেশি ঋণ পরিশোধে বাজেট থেকে আলাদা বরাদ্দ ব্যবহার করা হলেও এই ব্যয়ের ভার অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

সরকার রাজস্ব ঘাটতি পূরণে শুল্ক-কর বৃদ্ধি ও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাব বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব পদক্ষেপ অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে আরও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

রাজস্ব আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় বাজেট ঘাটতি মেটাতে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সরকার বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন দাতার কাছে ১৭০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে সরকার। তবে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র ৬০ কোটি ডলার।

এডিপিতে অর্থ সংকোচন

এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মাত্র ৫২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগের সমান।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ কমানো সম্ভব নয়। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার এডিপি বাজেটে ৩০-৩৫ হাজার কোটি টাকা কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি সহায়তা থেকেই কমানো হবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।

এডিপি বাস্তবায়নের নিম্নহার

জুলাই-নভেম্বর সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ১২ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও গত জুলাইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাব এডিপি বাস্তবায়নে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।

অর্থনীতির শ্লথ গতি

উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ কমানোর প্রভাব অর্থনীতিতে আরও সংকোচন ঘটাতে পারে। গত চার-পাঁচ মাস ধরে অর্থনীতি এমনিতেই স্থবির। জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ১ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে, যা কোভিডের সময়েও হয়নি।

অর্থ ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বাজেটের অর্থ ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন:

  1. দাতাদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা দ্রুত ছাড় করানো।
  2. প্রকল্পের বিদেশি ঋণ দ্রুত ছাড়ের উদ্যোগ নেওয়া।
  3. সরকারি অর্থের অপচয় ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করা।
  4. সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ পরিচালন খরচ অন্তত দুই বছর বাড়তে না দেওয়ার ব্যবস্থা করা।

সরকারি খরচে লাগাম টানতে এবং উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন সীমিত করার সিদ্ধান্ত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।