
প্রতিবেদক: দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নিয়ে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, বাজেটটি বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে—আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে সরকার কীভাবে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে চায়?
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশ্বাস এবং চলমান আলোচনার বিপরীতে বাজেট ঘোষণায় আশানুরূপ কোনো সাহসী প্রণোদনা দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ ঋণ ব্যয় এবং আমদানি হ্রাসের মতো সংকটময় প্রেক্ষাপটে একটি শক্তিশালী প্রণোদনামূলক বাজেট প্রয়োজন ছিল।
সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো টার্নওভার ট্যাক্স বৃদ্ধি, যা ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। এই কর লাভ-লোকসানের তোয়াক্কা না করেই দিতে হয়, ফলে এটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ‘শাস্তিমূলক’ বলে মনে করছেন অনেকে। সীমিত মুনাফা, ঋণখরচ এবং বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাসের বাস্তবতায় এ কর ব্যবসাগুলোর টিকে থাকা কঠিন করে তুলবে।
রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস পোশাক খাত বলছে, বাজেটে তাদের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে চাহিদা হ্রাসের প্রেক্ষাপটে তুলা ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর ভ্যাট আরোপ খাতটিকে আরও দুর্বল করে তুলবে বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
কর্পোরেট মহল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংকীর্ণ করদাতা গোষ্ঠীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে। একইসঙ্গে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপরও পরোক্ষ কর বৃদ্ধির ফলে প্রকৃত আয় হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে ভোক্তানির্ভর প্রবৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি হবে, যা শিল্প ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বলেছে, বাজেটে বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবনের জন্য কার্যকর পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ জিডিপির ২৯.৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। সরকারি জটিলতা ও অবকাঠামোর ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করছে বলেও সংস্থাটি জানিয়েছে।
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেছেন, বাজেটে নতুন বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থান উৎসাহিত করতে কোনো নীতিগত সহায়তা রাখা হয়নি। কাঁচামাল আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক এবং সরকারের ব্যাংক ঋণ গ্রহণের ফলে ঋণের ব্যয় বাড়বে, যা বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অফ ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেছেন, বাজেটটি মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুসরণে প্রণীত। এর ফলে দেশীয় শিল্পখাত ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, তুলা ও কৃত্রিম তন্তুর সুতার ওপর ভ্যাট কেজিপ্রতি ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত দেশীয় স্পিনিং মিলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ইস্পাত ও সিমেন্ট খাতে শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধিও নির্মাণ খাতে ব্যয় বাড়িয়ে দেবে।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) বাজেটের কিছু ইতিবাচক দিক স্বাগত জানালেও, তালিকাভুক্ত কোম্পানির ওপর অতিরিক্ত কর, অনলাইন বিক্রিতে ভ্যাট বৃদ্ধি এবং কর রিবেটে বিলম্বের কারণে ব্যবসার গতিশীলতা ব্যাহত হতে পারে বলে সতর্ক করেছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) বলেছে, বাজেটে সিএমএসএমই, ব্যবসা সহজীকরণ এবং ব্যাংকিং খাতের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার অনুপস্থিত। সংগঠনটির মতে, এটি ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ গঠনের পথে অন্তরায়।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)-এর চেয়ারম্যান আবুল কাশেম খান কর কাঠামোর অসামঞ্জস্য, বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতা এবং রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, তুলা ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইউসিবি চেয়ারম্যান ও অনন্ত অ্যাপারেলসের এমডি শরীফ জহির বলেন, শিল্প খাত বহু চাপে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন কর ও ভ্যাট শিল্পে চাপ বাড়াবে, স্বস্তি দেবে না।
বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদ বাজেটে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী প্রস্তুতির অভাব তুলে ধরেন। করনীতি প্রতিকূল এবং ব্যবসাবান্ধব নির্দেশনার ঘাটতির কথাও তিনি বলেন।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শুল্ক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না এলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। এখনো একটি পণ্য খালাসে ১৭টি স্বাক্ষরের প্রয়োজন, যা ব্যবসার জন্য বড় বাধা বলে তিনি উল্লেখ করেন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর দেশের ব্যবসায়ী মহলে স্পষ্ট হতাশা ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাজেট বাস্তবায়ন এবং কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এ অবস্থার উত্তরণ সম্ভব নয় বলে মত দিচ্ছেন অধিকাংশ উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষক।