বাড়ছে করের বোঝা, সীমিত আয়ের মানুষ পড়ছে আরও সংকটে

প্রতিবেদক: চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতেও আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সাধারণ করদাতাদের জন্য আয়করে বড় কোনো ছাড় আসছে না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে না—অর্থাৎ করমুক্ত আয়ের বর্তমান সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকাই থাকছে। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য কর ছাড় থেকে স্বস্তি পাওয়ার আশা ক্ষীণ।

অন্যদিকে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ওপর করের হার বাড়ানো হতে পারে। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানিগুলোর করপোরেট কর ২.৫% বাড়িয়ে ২৭.৫% করার প্রস্তাব রয়েছে। আবার ব্যবসা লাভে থাকুক বা লোকসানে, নির্দিষ্ট হারে যে কর দিতে হয়—সেটিও বাড়িয়ে ১% করা হতে পারে। তবে, কিছু কিছু খাতে করছাড় বা শিথিলতা আনা হচ্ছে। যেমন: ব্যক্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর কমিয়ে নতুন করদাতাদের জন্য এক হাজার টাকা করা হতে পারে। এছাড়া জমি কেনাবেচায় করের হার কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

আসন্ন বাজেটটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট এবং তা উপস্থাপন করবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি আগামীকাল সোমবার জাতির উদ্দেশে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে বাজেট ঘোষণা করবেন।

এবার করমুক্ত আয়সীমা না বাড়ালেও ভবিষ্যতের জন্য কিছু ঘোষণা আসতে পারে। যেমন, আগামী দুই করবর্ষে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় উন্নীত করার ইঙ্গিত থাকতে পারে। এছাড়া, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত গেজেটভুক্ত ব্যক্তিদের জন্য করমুক্ত সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার সম্ভাবনাও রয়েছে।

বর্তমানে দেশে ১ কোটি ১১ লাখ টিআইএনধারী থাকলেও বছরে মাত্র ৪০ লাখের মতো রিটার্ন জমা দেন। করদাতাদের সংখ্যা বাড়াতে এবং রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা কমাতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। যেমন: সঞ্চয়পত্র কেনার সময় রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা উঠে যেতে পারে। তবে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা বহাল থাকবে।

করমুক্ত দানের আওতা বাড়ানো হচ্ছে। এখন স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, সন্তান ছাড়াও আপন ভাইবোনকে দেওয়া দান করমুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে চাকরিজীবীদের জন্য করযোগ্য আয় গণনায় বাদযোগ্য ভাতার সীমা ৪.৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হতে পারে। নিয়োগকর্তার দেওয়া আর্থিক সুবিধার (পারকুইজিট) অনুমোদনের সর্বোচ্চ সীমাও ১০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লাখ টাকা করা হচ্ছে।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের আওতাধীন পেনশন স্কিম থেকে প্রাপ্ত আয় সম্পূর্ণ করমুক্ত থাকবে। পাশাপাশি, মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭.৫% থেকে কমিয়ে ২৭.৫% করার প্রস্তাব আনা হচ্ছে। সিকিউরিটিজ লেনদেনের ওপর করও কমতে পারে।

জমি কেনাবেচায় করহার কমানো হচ্ছে, যাতে করে কালোটাকা সাদা করার প্রবণতা হ্রাস পায়। বর্তমানে জমির ওপর কর এলাকাভেদে ৮, ৬ ও ৪ শতাংশ থাকলেও তা কমিয়ে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব রয়েছে। তবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আবারও থাকছে, যদিও এই করহার এলাকাভেদে বাড়ানো হতে পারে। অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগও রাখা হতে পারে।

পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদের ওপর কর ও জরিমানার ঘোষণা আসতে পারে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যারা পরবর্তীতে নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন এবং বিদেশে অর্জিত সম্পদ কর ফাঁকি দিয়ে গোপনে রেখেছেন, তাদের অর্থের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আবগারি শুল্কের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। ব্যাংক হিসাবে বর্তমানে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতে কোনো শুল্ক নেই, তা বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা করা হতে পারে। আবগারি শুল্কের স্তরও পুনর্বিন্যাস করার পরিকল্পনা রয়েছে।

ভ্যাট ও শুল্কেও পরিবর্তনের ফলে কিছু পণ্যের দাম বাড়তে বা কমতে পারে। রেফ্রিজারেটর, এসি ও মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে। আবার চিনি, বিদেশি মাখন, সিরিশ কাগজ, বাস, মাইক্রোবাস, ক্রিকেট ব্যাটের দাম কমতে পারে। রড, ফেসওয়াশ, লিপস্টিক ও চকলেটের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এবারের বাজেটে উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার না দেওয়ায় সমালোচনা হচ্ছে। জাতীয় বাজেটের পরিকল্পনায় শ্বেতপত্র ও টাস্কফোর্সের সুপারিশ প্রতিফলিত হয়নি বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সরকার গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য সেলিম রায়হান মন্তব্য করেন, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকার যদি পুরোনো ছকে একটু এদিক-সেদিক করে বাজেট করে, তাহলে সেটি হতাশাজনক হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটি জনকল্যাণমুখী, বৈষম্যবিরোধী বাজেট দেওয়ার সুযোগ ছিল। কর্মসংস্থান সৃষ্টিমুখী ও সামাজিক ন্যায়ের ভিত্তিতে বাজেট তৈরি করলে তা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সরকারের জন্য একটি আদর্শ হতো।” তাঁর মতে, বাজেট প্রণয়নে সময়ের অভাবের অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে নয় মাস সময় পেয়েছে।