
প্রতিবেদক: দেশের একমাত্র তামার তার প্রস্তুতকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। একসময় তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি), যারা প্রতিবছর গড়ে ৪০০ টন তামার তার কিনত। কিন্তু গত চার বছর ধরে বিআরইবি আর তাদের কাছ থেকে কোনো তার নিচ্ছে না। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন গভীর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরেও গাজী ওয়্যারসের লোকসান ৫ কোটি টাকার বেশি। তার আগের বছর লোকসান হয়েছিল ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অথচ এর আগের কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ছিল লাভজনক। ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত মোট লাভ ছিল ৭৩ কোটি টাকার বেশি।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিআরইবি শেষবারের মতো গাজী ওয়্যারসের তার কিনেছিল। এরপর তারা দাম বেশি হওয়ার অজুহাতে আর কিনছে না। অথচ গাজী ওয়্যারসের দাবি, তারা ভালো মানের তার উৎপাদন করে থাকে। বর্তমানে তারা চেষ্টা করছে সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করার জন্য। যেমন—বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, পেট্রোবাংলা এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তর।
গাজী ওয়্যারসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম জানান, গত ২২ মে বিআরইবি তাদের কারখানা পরিদর্শন করেছে এবং দাম নিয়ে নতুন করে আলোচনা চলছে। তিনি আশা করছেন, আবার তারা ক্রয় শুরু করলে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। পাশাপাশি জ্বালানি মন্ত্রণালয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাজী ওয়্যারসের পণ্য কিনতে নির্দেশনা জারি করেছে।
গাজী ওয়্যারসের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা দেড় হাজার টন হলেও বাস্তবে তা কখনোই পূরণ হয়নি। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৮০০ টন উৎপাদন করতে পারলে তারা অন্তত লোকসানে পড়ত না। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয় মাত্র ২৬৭ টন, আর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) তা আরও কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৮৭ টন।
প্রতি কেজি তামার তার উৎপাদনে খরচ পড়ে ১,৬০০ থেকে ১,৮০০ টাকা, যা বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, একক ক্রেতার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোগের ঘাটতি এই লোকসানের অন্যতম প্রধান কারণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব বিজনেস রিসার্চের পরিচালক অধ্যাপক মো. আলী আরশাদ চৌধুরী বলেন, “যতক্ষণ না নতুন বাজার ও ক্রেতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ এই প্রতিষ্ঠান লাভে ফিরবে না। সরকারকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
গাজী ওয়্যারসের দুর্দশার পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ইতিহাস। ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির শক্তিশালী ও আধুনিকীকরণ প্রকল্পে অনিয়ম ধরা পড়ে। ৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও সেগুলোর উৎপাদনকারী দেশ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কেনার আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি।
এই অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার তথ্য উঠে এসেছে বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে, যা গাজী ওয়্যারসের প্রশাসনিক দুর্বলতা ও ব্যবস্থাপনাগত সংকটের প্রমাণ বহন করে।
একসময় লাভজনক থাকা গাজী ওয়্যারস আজ ধুঁকছে বাজার সংকোচন, একক নির্ভরতা, উৎপাদন ব্যয় ও ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায়। বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণে প্রয়োজন বহুমুখী বাজার গড়ে তোলা, সরকারি ক্রয় নীতির কার্যকর প্রয়োগ এবং ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। না হলে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে।