
অনলাইন ডেক্স:বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আগের মতোই ব্যাংক থেকে চাঁদা তোলা শুরু করেছে। সাম্প্রতিক “প্রথম আলোর” এক প্রতিবেদনে এইসব কথা উঠে এসেছে।
বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আবারও ব্যাংক থেকে চাঁদা সংগ্রহ শুরু করেছে। সম্প্রতি সংগঠনটি প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণভান্ডারে কম্বল দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ উল্লেখ করে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা আন্তর্জাতিক ম্যারাথনে ৪ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোর কাছে চাঁদা নির্ধারণ করে অনুরোধ পাঠিয়েছে।
বিএবির এই উদ্যোগ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। অন্তত ছয়টি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৎকালীন বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংকগুলো থেকে বিভিন্ন ইস্যুতে চাঁদা সংগ্রহ করতেন। অভিযোগ রয়েছে, সংগৃহীত অর্থ তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হতো। বিনিময়ে ব্যাংকগুলো ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ নীতিমালার বিভিন্ন শর্ত থেকে ছাড় পেত। তবে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নজরুল ইসলাম মজুমদার এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বিএবির চেয়ারম্যান পদ থেকেও অপসারিত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাতে এ বিষয়ে বলেন, ‘বিএবি এর আগে চাঁদাবাজির মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে সংকটে ফেলে দিয়েছিল। নতুন কমিটি যদি একই পথ অনুসরণ করে, তা হলে সেই উদ্যোগ দ্রুত বন্ধ করা উচিত। জনগণের আমানত নিয়ে আর খেলা চলতে দেওয়া যাবে না। ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হওয়া উচিত। বিএবির এই অর্থে হাত দেওয়ার অধিকার নেই।’
২০০৮ সাল থেকে ১৭ বছর ধরে বিএবির চেয়ারম্যান ছিলেন এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। ওই সময় তিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তাঁর নেতৃত্বাধীন বিএবির দুই ভাইস চেয়ারম্যানও ব্যাংকের পরিচালক পদ হারিয়েছেন। তাঁরা হলেন আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সর্বশেষ আয়োজন করেছিল ‘শেখ হাসিনা আন্তব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট’। এ আয়োজনে ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। ব্যাংকারদের মতে, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে বিএবি বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাংকগুলো থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা চাঁদা তুলেছে। সরকার বদলের পর এসব টাকার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং নিরীক্ষার দাবি জানানো হয়।
গত ১০ বছরে ব্যাংকগুলো প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা দিয়েছে। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দেয়, ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের (সিএসআর) ৫ শতাংশ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্টে অনুদান হিসেবে দিতে হবে। একই নির্দেশনা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও মেনে চলতে বলা হয়।
সম্প্রতি ঢাকা আন্তর্জাতিক ম্যারাথনের জন্য চাঁদা চেয়ে বিএবি ব্যাংকগুলোতে চিঠি দিয়েছে। চাঁদার পরিমাণ সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক ব্যাংকের এমডি জানান, গত ১৫ বছরে তিনি প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছেন। সরকার বদলের পর চিঠি পেয়ে কম্বল কিনে জমা দিয়েছেন, এবং ম্যারাথনের জন্যও চাঁদা দিতে হবে বলে জানিয়েছেন।
গত সেপ্টেম্বরে বিএবি নতুন অস্থায়ী (অ্যাডহক) কমিটি গঠন করে। চলতি মাসে পুনর্নির্বাচিত কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন ঢাকা ব্যাংকের আবদুল হাই সরকার। ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ও ব্যাংক এশিয়ার রোমো রউফ চৌধুরী।
তবে ব্যাংক মালিকদের অভিযোগ, নতুন কমিটিও আগের মতো চাঁদা আদায়ের পথে হাঁটছে। ডিসেম্বরের চিঠিতে প্রতিটি ব্যাংকের জন্য কম্বলের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয় এবং জানানো হয়, প্রতিটি কম্বলের ওজন কমপক্ষে ১,২০০ গ্রাম হতে হবে। ৫ জানুয়ারির চিঠিতে জানানো হয়, ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক ম্যারাথনের জন্য ৪ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলোকে ৮ জানুয়ারির মধ্যে নির্ধারিত অর্থ জমা দিতে বলা হয়। অথচ আয়োজকদের চিঠি অনুযায়ী, প্রধান স্পনসরের জন্য সর্বোচ্চ চাঁদা ২ কোটি টাকা। ফলে ৪ কোটি টাকা চাঁদা তোলার কারণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দুটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানান, আগে শীত, গরম, ঝড় কিংবা বৃষ্টি যেকোনো ইস্যুতে ব্যাংক থেকে চাঁদা তোলা হতো। এতে ব্যাংকের সিএসআর তহবিল প্রায় শূন্য হয়ে যেত। এখনো একই পথ অনুসরণ করছে বিএবি। ফলে ব্যাংকগুলোর পক্ষে সঠিকভাবে সিএসআর কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘বিএবির চাঁদাবাজি বন্ধ করা উচিত। এ ধরনের কার্যক্রম তাদের শক্তিশালী করে তোলে এবং আইন পরিবর্তনের মতো ক্ষমতা এনে দেয়, যা ব্যাংক খাতের জন্য ক্ষতিকর। সিএসআর তহবিলের অর্থ সুনির্দিষ্ট খাতে ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে এই অর্থ ব্যবহারের সুযোগ দিতে হবে।’
বিএবির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এটি একটি পরামর্শমূলক সংগঠন। ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানে এটি বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। ১৯৯৩ সালে ৯টি ব্যাংকের উদ্যোক্তারা মিলে বিএবি গঠন করেন। বর্তমানে ৩৮টি ব্যাংক এর সদস্য। ব্যাংকগুলোর চাঁদার মাধ্যমেই সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তবে বিএবির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের মন্তব্য জানতে চাইলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।