
প্রতিবেদক: বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি এবং এর সঙ্গে যুক্ত অভিনেতা ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ইরেশ যাকের সাম্প্রতিক সময়ে একটি ‘পরিকল্পিত বিতর্ক’ ও বহুমুখী প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের ফল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা ইরেশ যাকের সম্প্রতি সেই আন্দোলন ঘিরে দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় নাম উঠে আসার পর নতুন করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে মামলার সাক্ষীদের ভাষ্যমতে, তারা মামলার বিষয়েও জানতেন না এবং অনুরোধে নাম দিয়েছেন।
মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমি কিছুই জানি না। কীসের মামলা তাও জানি না। একজন নাম দিতে বলেছিল, তাই দিয়েছি। এতে মামলার স্বচ্ছতা ও আইনগত গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একই রকম ঘটনায় আরও কয়েকজন অভিনয়শিল্পীর বিরুদ্ধেও মামলা হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অভিনয়শিল্পী সংঘ। সংঘের সভাপতি আজাদ আবুল কালাম বলেন, “এটি অবাস্তব অবস্থা। ঢালাওভাবে মামলা দিয়ে, একের পর এক হয়রানি চালিয়ে সমাজে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “ইরেশ যাকের আমাদের সঙ্গে রাস্তায় ছিল। তাকে মামলায় ফেলে হেয় করার যে প্রবণতা, তা সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা দরকার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে চলছে পক্ষে-বিপক্ষে তীব্র প্রচারণা। কেউ বলছেন, এশিয়াটিক একটি সফল প্রতিষ্ঠান— তাদের ব্যবসায়িক আধিপত্য অপরাধ নয়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, “আপনি প্রতিপক্ষকে হত্যা মামলায় জড়িয়ে কি চূড়ান্তভাবে হারাতে চান?”
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “আজ আমি ইরেশ ভাইয়ের পাশে আছি। এসব বস্তাপচা, ঢালাও মামলা দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছেন, সেটা স্পষ্ট নয়।
এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর আবেদনে এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৭টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, কোনো পূর্ব নোটিশ ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার ফলে কর্মচারী, ভেন্ডর এবং তাদের পরিবার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।
এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির চেয়ারম্যান এবং অভিনেত্রী সারা যাকের এক বিবৃতিতে বলেন, “গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে একটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। তিনি আরও জানান, ২৪ এপ্রিল ব্যাংক হিসাব জব্দ, এরপর ২৭ এপ্রিল হত্যা মামলার অভিযোগ— এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
সারা যাকেরের অভিযোগ, যে প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি ছিল সৃজনশীলতা, পেশাদারিত্ব ও নৈতিকতা, তাকে ধ্বংসের জন্য একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
এশিয়াটিকের হেড অব এইচআর অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স ফারাহ তানজীন সুবর্ণা বলেন, ইরেশ যাকের কখনও আওয়ামী লীগের দোসর ছিলেন না। বরং আমার স্বামী র্যাবের হাতে চার বছর আটক ছিলেন, তখন সরকার ছিল আওয়ামী লীগের। যদি পক্ষপাত থাকত, তাহলে আমাকেই চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হতো।
তিনি আরও বলেন, এসব অপপ্রচার আসলে পেশাগত ঈর্ষা এবং আর্থিক প্রতিযোগিতার বহিঃপ্রকাশ। আমরা সরকারের কাছে এই ষড়যন্ত্রের তদন্ত দাবি করছি।তিনি জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে সাজানো প্রচারণা চালাচ্ছেন, যা অন্যরাও শেয়ার করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্রের মতে, অপপ্রচারকারীরা নিজেরা চক্রান্ত করলেও রাষ্ট্রীয় কোনো কোনো সংস্থা উল্টো ভিক্টিমদের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ নিচ্ছে— যা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। তারা বলছেন, বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাসে এতটা ব্যক্তিস্বার্থ ও প্রতিহিংসার অপব্যবহার নজিরবিহীন।
ইরেশ যাকের বলেন, আমি যেখানে হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে, সেখানে আমাকে হত্যা মামলার আসামি করা এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা বুঝিয়ে দেয়— কেউ না কেউ সচেতনভাবে এটা করছে। আমি এখনও বুঝতে পারছি না, কার কী স্বার্থে আমার পেশাগত, সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবন ধ্বংস করতে চায়।
ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাকে গভীরভাবে উদ্বেগজনক ও পীড়াদায়ক বলে অভিহিত করেছেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, মামলা ব্যক্তিগতভাবে দায়ের হয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের নয়। তবে এই মামলার ধরনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার অপব্যবহার দেখা যাচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও সাংবাদিকদের বলেন, মামলা করতেই পারেন কেউ, কিন্তু মামলার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তদন্ত করতে। কারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা করছে, তা খুঁজে বের করা দরকার।”
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ও মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. সাজ্জাদ রোমান জানান,আদালতের নির্দেশে মামলাটি এজাহারভুক্ত হয়েছে। তবে তদন্তের ভিত্তিতে নিরপরাধ কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে আমরা সতর্ক। তদন্ত হবে নিরপেক্ষ ও প্রমাণভিত্তিক।
এশিয়াটিকের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বড় হয়েছি, সেটা কারও ঈর্ষার কারণ হতে পারে, কিন্তু এটি তো অপরাধ নয়। এশিয়াটিক বা ইরেশ যাকেরকে ‘সরকারঘেঁষা’ বলেও যারা আক্রমণ করছেন, তাদের অনেকে নিজেরাও বড় কর্পোরেট সংস্থার হয়ে কাজ করছেন।
সোশ্যাল ও মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেন, একটি কোম্পানিকে টার্গেট করে ব্যক্তিগতভাবে মালিককে অভিযুক্ত করা যুক্তিসঙ্গত নয়। এটি বহুদিনের ক্যাম্পেইনের অংশ।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, মিডিয়ার প্রতিবেদন বা গুজবের ভিত্তিতে মামলা গ্রহণ এখন বেড়ে গেছে। এতে হয়রানি বাড়ছে। এসব এক ধরনের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’— যা আইনসিদ্ধ নয় এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থার সংকট তৈরি করছে।