
প্রতিবেদক: বিদেশে গড়ে তোলা অপ্রদর্শিত সম্পদ আর লুকিয়ে রাখা যাবে না—এমনই কঠোর পদক্ষেপ এনেছে আয়কর আইনের ২১ ধারায়। এতদিন ‘নিবাসী বাংলাদেশি’ শব্দের ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচে থেকে অনেকেই বিদেশে থাকা সম্পদ আয়কর রিটার্নে না দেখিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছিলেন। অনেকে তো বাংলাদেশের নাগরিকত্বও ত্যাগ করেছিলেন। তবে এখন থেকে জন্মসূত্রে বাংলাদেশি যে কেউই আইনের আওতায় আসবেন।
২০২৫ সালের অর্থ অধ্যাদেশে আনা সংশোধনের মাধ্যমে এ পরিবর্তন কার্যকর হচ্ছে আগামী ১ জুলাই থেকে। এতে বলা হয়েছে, ২১ ধারার উপধারা (১)-এ ‘নিবাসী বাংলাদেশি’ শব্দের জায়গায় ‘করদাতা বা জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন বা আছেন’ শব্দগুলো সন্নিবেশিত হবে।
বর্তমান বিধান অনুযায়ী, কেউ বাংলাদেশে নিবাসী হলে এবং তাঁর বিদেশে অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকলে তা আয়কর রিটার্নে দেখানো বাধ্যতামূলক। তা না করলে বিদেশ ও দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে সম্পদের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ জরিমানা করার সুযোগ রয়েছে। এমনকি করদাতার নিজস্ব বা প্রতিনিধির অন্যান্য সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেও এই জরিমানা আদায় করা যাবে।
তবে আগের আইনে কেবল বাংলাদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই ধারা প্রয়োগ করা যেত, ফলে যারা নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন, তারা আইনের ফাঁক গলে পার পেয়ে যেতেন। নতুন সংশোধনের মাধ্যমে এখন সাবেক বাংলাদেশি নাগরিকরাও আইনের আওতায় আসবেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, এ সংশোধনের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপসহ দেশি-বিদেশি বড় করদাতাদের আইনের আওতায় আনার লক্ষ্য রয়েছে। এনবিআরের দাবি, এই সংশোধন অর্থ পাচার ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ গড়ার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আইনগত হাতিয়ার হয়ে উঠবে।
এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম বলেন, “নিবাসী শব্দের কারণে তদন্ত ও অনুসন্ধানে জটিলতা তৈরি হচ্ছিল। তাই এবার ‘জন্মসূত্রে বাংলাদেশি’ শব্দ যোগ করা হয়েছে। এখন নিবাসী বা অনিবাসী—দুই ধরনের ব্যক্তিই যদি জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হন, তাহলে তাঁদের বিদেশে সম্পদ থাকলে তা রিটার্নে প্রদর্শন করতে হবে, না করলে জরিমানার আওতায় আসবেন।”
যদিও ২১ ধারাটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্ত হয়েছিল, গত তিন বছরে শুধু একটি অনুসন্ধান হয়েছে বলে জানা গেছে। এ সময় গণমাধ্যমে বহুবার বিদেশে অবৈধ সম্পদের তথ্য ফাঁস হলেও তার আদালত বা কর প্রক্রিয়ায় প্রতিফলন খুবই সীমিত।
সিআইসি (কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল) এ অনুসন্ধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও তাদের কার্যক্রম সীমিত ছিল। সিআইসি’র মহাপরিচালক আহসান হাবিব বলেন, “২১ ধারা কেবল সিআইসি নয়, সব কর অঞ্চল প্রয়োগ করতে পারে। সিআইসি সদস্যরা কয়েকটি দেশে গিয়ে সম্পদ শনাক্তও করেছেন।
আইন সংশোধন করে নতুন ধারা কার্যকর করা গেলেও প্রশ্ন উঠেছে—যারা ইতিমধ্যে নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন, তাঁদের থেকে আদায় কীভাবে নিশ্চিত হবে?
আয়কর পরামর্শক স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “বিধানটি আয়কর রিটার্নে সম্পদ প্রদর্শনের নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন, যাতে কর ফাঁকিদাতাদের জরিমানার নজির তৈরি হয়। কিন্তু নাগরিকত্ব ত্যাগকারীদের বিরুদ্ধে বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হয়ে থাকবে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান জানান, “এটা অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। কী পরিমাণ সম্পদ শনাক্ত হয়েছে, কত কর আদায় হয়েছে—তা বাজেট শেষে গণমাধ্যমে জানানো হবে।”
এনবিআর বলছে, আগামী বাজেটের পরে আয়কর পরিপত্রে ‘জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন বা আছেন’ বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা থাকবে।
বিদেশে সম্পদ গড়েও করের দায় এড়ানোর সুযোগ এখন শেষের পথে। নতুন সংশোধিত আয়কর আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী, নিবাসী না হলেও জন্মসূত্রে বাংলাদেশি হলেই বিদেশি সম্পদ রিটার্নে দেখাতে হবে, না হলে আর্থিক জরিমানাসহ শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তবে আইনের বাস্তব প্রয়োগই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।