
প্রতিবেদক: বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগে পিছিয়ে পড়েছে। ২০২৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি এবং প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম। এমন পরিস্থিতিতে, বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) তাদের ‘কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক (CPSD)’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচটি বড় বাধা চিহ্নিত করেছে। এ বাধাগুলো হলো বিদ্যুৎ সমস্যা, সীমিত অর্থায়ন, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য এবং উচ্চ করহার।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা জানান, দেশে বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায় পরিবেশ এখনও খুব সুবিধাজনক নয়, এবং আগের মতোই বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। আইএফসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের বিদেশি বিনিয়োগ কমে গেছে প্রায় ১৪ শতাংশ, যা সারা বিশ্বে কমেছে মাত্র ২ শতাংশ। বাংলাদেশ ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে, কিন্তু ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে অনেক বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।
আইএফসি আরও বলছে, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগে বাধা হিসেবে মূলত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নীতির ঘন ঘন পরিবর্তন, আইনের জটিলতা, এবং প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতা রয়েছে। এই সমস্যাগুলোর কারণে বিদেশি কোম্পানির সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং বর্তমানে শুধু দেশে ব্যবসা করা বিদেশি কোম্পানিগুলিই বিনিয়োগ করছে, নতুন কোম্পানি আসছে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে কিছু কৌশলগত খাতে উন্নতি সাধন হলে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। এগুলোর মধ্যে আবাসন, পেইন্ট অ্যান্ড ডাইস, তৈরি পোশাক শিল্প এবং ডিজিটাল আর্থিক সেবা খাতের উন্নয়ন সম্ভব। তবে এসব খাতের উন্নতির জন্য ডিজিটাল ম্যাপিং, জমি নিবন্ধন, শুল্ক ব্যবস্থাপনা ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা সমাধান করা দরকার।
আইএফসি আরও বলেছে, বাংলাদেশ যদি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পরে ইউরোপে রপ্তানি বাড়াতে চায়, তবে শুল্কহার বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পরিপালন করতে হবে। দেশকে আরও আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিবেশগত ও শ্রমিক নিরাপত্তা মান বজায় রেখে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে হবে।
আইএফসির প্রতিবেদন প্রকাশের পর দুইটি আলাদা প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী এবং বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন। এই সেশনটি পরিচালনা করেন আইএফসির বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হোল্টম্যান।
লুৎফে সিদ্দিকী প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আইএফসির প্রতিবেদনে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো নতুন নয়, বরং আগে থেকেই বিদ্যমান। তবে তিনি আশাবাদী যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসব সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী। একইভাবে, বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী জানান, সরকার এখন প্রধানত কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে মনোযোগী, এবং আইএফসির সুপারিশগুলো সরকারের কাজের জন্য সহায়ক হবে।
দ্বিতীয় প্যানেল আলোচনায় অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহির দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তিনি অবকাঠামোগত সমস্যার কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, যদি এটি সমাধান করা যায়, তাহলে বর্তমান কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া, পরিবহন, সরবরাহ খাত, গ্যাস-বিদ্যুতের মতো পরিষেবা এবং শুল্ক-কর সম্পর্কিত সমস্যাগুলোরও সমাধান প্রয়োজন। তিনি বলেন, এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব, তবে এজন্য একটি সুস্পষ্ট পথনকশা থাকা আবশ্যক।
এছাড়া, ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন এবং এবিসি রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্রাবন্তী দত্ত আবাসন খাত নিয়ে আলোচনা করেন। শ্রাবন্তী দত্ত বলেন, ঢাকা শহরের জমির অতিরিক্ত দামের কারণে সাধারণ মানুষের জন্য কম খরচে আবাসন সম্ভব হচ্ছে না, কারণ মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশই জমির খরচে চলে যায়। তবে তিনি পরামর্শ দেন, আবাসন খাতের উন্নতির জন্য সহজ শর্তে ঋণ, দীর্ঘমেয়াদি মর্টগেজ সুবিধা এবং করছাড়ের মতো নীতিসহায়তা প্রয়োজন।
সেলিম আর এফ হোসেন গৃহঋণের জন্য স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার বাণিজ্যিক বাস্তবতা নিয়ে আলোচনা করেন এবং সরকারকে পৃথক গৃহঋণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন।
সম্মেলনের মধ্যে, বিনিয়োগকারীরা প্রধানত দুটি বিষয় জানতে চেয়েছেন: প্রথমত, বাংলাদেশে ব্যবসা করলে সরকার কী সুবিধা দেবে, বিশেষ করে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমানোর জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এবং দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ব্যবসা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলায় সরকার কী পদক্ষেপ নেবে।
উল্লেখযোগ্য, বিনিয়োগ সম্মেলনে বিশ্বের ৫০টি দেশের ৫৫০ জনের বেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যবসা প্রতিনিধির অংশগ্রহণের কথা জানানো হয়েছিল। তারা চট্টগ্রামের কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), মিরসরাইয়ের জাতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল, এবং নারায়ণগঞ্জে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিদর্শন করেছেন।