বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থানে ধাক্কা

প্রতিবেদক: গাজীপুরের চন্দ্রায় অবস্থিত ‘টাওয়েল টেক্স’ নামের একটি কারখানা গত ১৪ এপ্রিল থেকে কার্যত গ্যাস-সংকটে ভুগছে। বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কারখানাটি মাত্র এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করতে পারছে, ফলে মাসে গড়ে ৬ লাখ ডলারের রপ্তানি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহাদাত হোসেন বলেন, “গত এক মাসে আমরা কোনো পণ্য রপ্তানি করতে পারিনি। এতে বেতন-ভাতা পরিশোধে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।”

শুধু এই একটি কারখানাই নয়, দেশের নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান একই ধরনের সংকটে রয়েছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকট ছাড়াও রয়েছে চড়া সুদের হার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—সব মিলিয়ে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ ভীষণ চাপের মধ্যে পড়েছে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেন, “শিল্পকারখানা ব্যাপকভাবে ভুগছে। ব্যাংকগুলো সহযোগিতা করছে না, ঋণ দিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলার অবস্থাও উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতি না বদলালে বিনিয়োগ বাড়বে না।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা ২৬% কমেছে এবং নিষ্পত্তিও কমেছে প্রায় ২৯%। এই হ্রাসপ্রাপ্ত হার নতুন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে ভাটা পড়ার স্পষ্ট প্রমাণ। একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭.৫৭ শতাংশ—স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম।

ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীরগতির প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ, যা আগের বছরের চেয়ে দেড় লাখ বেশি।

বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, “বিনিয়োগ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। রাতারাতি ফল পাওয়া যায় না। আমরা বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সংস্কার করছি।”

এদিকে বস্ত্র খাতেও গ্যাস-সংকট চরমে। বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন করেও গ্যাস না পাওয়ায় অনেক বস্ত্রকল তাদের সক্ষমতার মাত্র ৬০% ব্যবহার করতে পারছে। ফলে লোকসান বাড়ছে এবং নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে।

সরকারি দপ্তরে দুর্নীতি, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট এবং ব্যাপক লোডশেডিংয়ের কারণে গাজীপুরের একাধিক কারখানার কার্যক্রম থমকে গেছে। এক্সক্লুসিভ ক্যান নামের একটি কারখানার এমডি সৈয়দ নাসির বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ মিলছে না, আর কারখানায় গত মাসে ১৩০ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে।”

বিদেশি বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ৮৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬% কম।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, “বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান হয় না, আর তা না হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছে।”

সবমিলিয়ে বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, চড়া সুদের হার ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি মিলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে।