
প্রতিবেদক: চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত দেশের প্রথম সাবমেরিন টানেল চালুর পর থেকেই আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রকল্পটি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যয়বহুল এই টানেলটি উদ্বোধনের পর টোল আদায় শুরু হলেও পরিচালন ব্যয়ের তুলনায় তা অনেক কম। ফলে প্রতিটি অর্থবছরেই বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে গুনতে হচ্ছে বিপুল লোকসান। চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরেও সেই ধারা বজায় থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর উদ্বোধনের পর ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কর্ণফুলী টানেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হয়েছে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা। বিপরীতে টোল আদায় হয়েছে মাত্র ২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এতে প্রথম বছরেই লোকসান দাঁড়ায় প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা।
সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট খাতে খরচ হয়েছে ২২৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ টোল আদায় হয়েছে মাত্র ৩৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ফলে দ্বিতীয় বছরেই লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৯ কোটি টাকা।
সেতু কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে টানেল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ হতে পারে ২০৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বিপরীতে টোল বাবদ আয় ধরা হয়েছে মাত্র ৩৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এতে সম্ভাব্য লোকসান দাঁড়াবে ১৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
নদীর নিচ দিয়ে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল পরিচালনার জন্য প্রতিদিন প্রয়োজন পড়ে কৃত্রিম আলো, অক্সিজেন সরবরাহ, কার্বন ডাই–অক্সাইড নিষ্কাশন, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও জরুরি ব্যবস্থাপনা। এছাড়া রয়েছে কর্মীদের বেতন, বিদ্যুৎ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ। এই সকল কারণে টানেল পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য ৯৮৪ কোটি টাকায় টানেল পরিচালনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে টানেল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৮,৩০৫টি যান চলাচল করবে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হলেও, বাস্তবে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে গড়ে মাত্র ৪,০১৫টি গাড়ি টানেল ব্যবহার করেছে।
সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ জানিয়েছেন, বর্তমানে কম যান চলায় জনবল কমিয়ে খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত কমানো গেছে।
তিনি আরও জানান, টানেল দিয়ে যাতে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সরাসরি যানবাহন চলাচল করতে পারে সে লক্ষ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্ত থেকে কক্সবাজারমুখী একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। এটি সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে দ্রুত যাতায়াত সম্ভব হবে, যা যানবাহনের সংখ্যা ও টোল আদায় বৃদ্ধি করতে সহায়ক হবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) টানেলকে ঘিরে একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরও টানেল ঘিরে লজিস্টিক হাবসহ নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে টানেলের আশপাশে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য বাড়বে, যা দীর্ঘমেয়াদে টানেলটিকে লাভজনক করতে সহায়ক হবে।
প্রায় ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকায় চীনের ঋণে নির্মিত কর্ণফুলী টানেল দেশের প্রথম সাবমেরিন টানেল হলেও তার অর্থনৈতিক কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম দুই বছরের ক্ষতির হিসাবেই। তবে সরকার আশাবাদী, রুট সম্প্রসারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে টানেলটি লাভের মুখ দেখবে। এখন দেখা যাক, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প কত দ্রুত সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।