বৈশ্বিক বাণিজ্যে ট্রাম্পের শুল্কনীতির ধাক্কা: বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হুমকিতে

In বন্দর
April 20, 2025

প্রতিবেদক: প্রায় এক শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত থাকা বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা লাগে ২০২৫ সালের ২ এপ্রিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানিকৃত পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, যার প্রভাব পড়ে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতে। কারণ, ‘আমেরিকা যখন হাঁচি দেয়, তখন বিশ্ব অর্থনীতি ঠান্ডা হয়ে যায়।’

এই শুল্কনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চীন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশের পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক কম হলেও, তা একেবারে নগণ্য নয়—বিদ্যমান করের ওপর অতিরিক্ত ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

এই ঘোষণায় হতাশ ব্যবসায়ী মহল। কার্যাদেশ কমে গেছে, ক্রেতারা ছাড় দাবি করছে, আর পুঁজিবাজারে দেখা দিয়েছে ধস।

এই শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা ছিল গত ৯ এপ্রিল রাত থেকে। তবে ঠিক আগমুহূর্তে ট্রাম্প ৯০ দিনের জন্য তা স্থগিত রাখেন—তবে শুধু কিছু দেশের জন্য। চীনের ক্ষেত্রে এই স্থগিতাদেশ প্রযোজ্য নয়। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রে সব আমদানি পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকবে বলে জানানো হয়।

২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে কঠোর শুল্কনীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের বিক্রি বাড়ানো এবং উচ্চ প্রযুক্তিপণ্য—বিশেষ করে মাইক্রোচিপের মতো সেমিকন্ডাক্টরের উৎপাদন দেশে ফিরিয়ে আনাই তার লক্ষ্য। এই খাতে বর্তমানে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। চীনে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় যে পণ্য ৪০০ ডলারে তৈরি হয়, যুক্তরাষ্ট্রে তার উৎপাদন খরচ ও সময় অনেক বেশি।

বাংলাদেশের ওপর শুল্ক কেন?

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশের ওপর শুল্ক বাড়ানোর পেছনে মূল কারণ—চাপ সৃষ্টি করে সর্বোচ্চ সুযোগ নেওয়া। ট্রাম্প জানেন, এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। তাই এখন চাপ সৃষ্টি করে ভবিষ্যতের জন্য দর কষাকষির সুবিধা আদায় করাই তার কৌশল।

তবে শ্রমঘন খাত হওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন পোশাক খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয় না। তারপরও, আলোচনায় সুবিধা পেতে বাংলাদেশসহ পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোকে শুল্কের আওতায় আনা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার। দেশের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশেরও বেশি যায় এই মার্কেটে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে।

কিন্তু নতুন শুল্ক আরোপের ফলে এখন পোশাকের ওপর শুল্ক ১৬.১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩.৫ শতাংশে। এতে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা সংকটে পড়েছেন।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে চীন ও ভিয়েতনামের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র বছরে ১০৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে, যার ৯.৩ শতাংশ আসে বাংলাদেশ থেকে।

করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে গত দুই বছরে রপ্তানি কমে গেলেও, সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা পুনরুদ্ধার ঘটেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে—যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬.৬৪ শতাংশ বেশি।

শুল্ক সুবিধার বাস্তবতা

আফ্রিকার ৩৯টি দেশ পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেলেও, বাংলাদেশ এই সুবিধা পায় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র স্বল্পোন্নত দেশের উৎপাদিত ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়, কিন্তু বাকি ৩ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক।

ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যনীতির এই নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই কৌশলে দেশটির রপ্তানিকারকদের সামনে নতুন করে টিকে থাকার লড়াই শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কনীতির কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ২০২৫ সালের ২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নতুন করে উচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। চীনের ওপর সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের ওপর শুল্ক ১৬.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৩.৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। ২০২৪ সালে দেশটি বাংলাদেশ থেকে ৮.৩৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় কিছুটা বেশি। বিপরীতে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, সয়াবিন বীজ, লোহা ও ইস্পাতসহ ২.২১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে ক্রেতাদের অর্ডার কমেছে, ছাড় চাওয়া শুরু হয়েছে এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

চীন ও ভিয়েতনাম এই শুল্কনীতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। যুক্তরাষ্ট্রে চীনা পণ্যের প্রবেশ ব্যয়বহুল হয়ে যাওয়ায় তারা বিকল্প বাজার খুঁজছে—বিশেষ করে ইউরোপ ও এশিয়ায়। এর ফলে শুরু হতে পারে ‘মূল্যযুদ্ধ’, যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা দাম কমানোর জন্য রপ্তানিকারকদের ওপর চাপ বাড়াবে। এতে বাংলাদেশসহ সব পোশাক উৎপাদনকারী দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

তবে এ সংকটের মধ্যেও কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদি চীন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া শুল্কের কারণে মার্কিন বাজারে প্রতিযোগিতা হারায়, তাহলে বাংলাদেশের সামনে বড় একটি বাজার দখলের সুযোগ আসতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষ শ্রমশক্তি, কম উৎপাদন খরচ এবং বড় উৎপাদন সক্ষমতা—এই তিনটি বাংলাদেশের বড় সম্পদ।

তবে ভারত ও পাকিস্তানের ওপর তুলনামূলকভাবে কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে কিছু অর্ডার ওইসব দেশে চলে যেতে পারে। এমনকি কিছু ক্রেতা তাদের অর্ডার মিশর, কেনিয়া ও তুরস্কের মতো দেশেও সরিয়ে নিতে পারে। ফলে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি পুরোপুরি কেটে যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও বাণিজ্য প্রতিনিধির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। ৯০ দিনের জন্য শুল্ক বিরতি চাওয়া হয়েছে এবং আরও ১০০ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। আগামী ২১ এপ্রিল ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনা করতে একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা গেলে তা বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগে রূপ নিতে পারে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক বলেন, “এটা একটা সুযোগ হবে যদি সঠিক উদ্যোগ নিতে পারি। অর্থবহ কূটনীতি না হলে এটি বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে।” হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ মনে করেন, “বাংলাদেশের উচিত এই পরিস্থিতিতে ইতিবাচক কিছু পাওয়ার লক্ষ্যে আলোচনায় বসা।”

র‌্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক সতর্ক করে বলেন, “চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত হলে বাংলাদেশ সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে পারে, তবে প্রস্তুতি না থাকলে কিছুই মিলবে না।” তিনি আরও বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া চীনা পোশাকের ৭৫ শতাংশই কৃত্রিম সুতা দিয়ে তৈরি, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো সে খাতে ততটা শক্তিশালী নয়। তাই এই খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

সব মিলিয়ে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য যেমন হুমকি, তেমনি সুযোগও। সঠিক কূটনৈতিক কৌশল, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এই পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে কাজে লাগাতে পারে।