ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে শুল্ক ও মাশুল বৃদ্ধি

প্রতিবেদক: আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হতে যাচ্ছে, যা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। একই সময়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সব ধরনের মাশুল এবং বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে ব্যবস্থাপনার মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা এসেছে, যা ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, আমদানিতে এ বাড়তি মাশুলের বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে এবং রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে।

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি ও কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান বলেন, ট্রাম্পের শুল্ক নিয়ে আমরা আগে থেকেই অস্বস্তিতে ছিলাম। এখন মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সেই অস্বস্তি আরও বাড়ানো হলো। তার মতে, ব্যবহারকারীদের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা ছাড়াই বন্দরের মাশুল বাড়ানো মোটেই যুক্তিসংগত নয়। কারণ রপ্তানিতে প্রতিটি সেন্ট নিয়ে দর-কষাকষি করতে হয়, তাই এই মাশুল বৃদ্ধিতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান মাশুলের হার অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য ও জাহাজ পরিবহন বাবদ আদায় হয়েছে প্রায় ৩,৯১২ কোটি টাকা। নতুন মাশুল কার্যকর হলে এতে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত আয় বাড়তে পারে, যার মানে অতিরিক্ত ১,৫০০ কোটি টাকার বেশি আদায় হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ডলারে মাশুল নির্ধারণ করায় ডলারের দর বাড়লেও আয় আরও বাড়তে পারে।

অন্যদিকে, বেসরকারি কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনও ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এতে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচ পড়তে পারে ব্যবহারকারীদের ওপর। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি খাতে সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীদের বাড়তি ব্যয় দাঁড়াবে আনুমানিক ১,৮০০ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাবনা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তাদের মতামত গ্রহণ করা হয়নি। শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংগঠন সর্বোচ্চ ১০-২০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু আলোচনার আগেই অর্থ মন্ত্রণালয় ৪০ শতাংশের মতো মাশুল বৃদ্ধির প্রস্তাবে অনুমোদন দেয়। ফলে ব্যবহারকারীরা হতবাক হয়ে গেছেন।

সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক মনে করেন, বিদেশি বন্দর অপারেটরদের সুবিধা দিতেই হঠাৎ মাশুল বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, বন্দর এমনিতেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান, অতীতে চট্টগ্রাম বন্দর খাতে যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে, তা উদ্ধার করলেই মাশুল বাড়ানোর দরকার হতো না।

রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে প্রথমে কারখানা থেকে কনটেইনার ডিপোতে পণ্য নেওয়ার সময় ডিপোর মাশুল দিতে হবে। এরপর বন্দরে নেওয়ার সময় বন্দর কর্তৃপক্ষ বাড়তি মাশুল আদায় করবে। তারপর যদি গন্তব্য হয় যুক্তরাষ্ট্র, তাহলে একই পণ্যের ওপর ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে। আমদানিতেও একইভাবে জাহাজ খাত থেকে শুরু করে কনটেইনার খালাস, সংরক্ষণ, এবং পরিবহনের প্রতিটি ধাপে বাড়তি মাশুল গুনতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ কনটেইনার আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। ফলে এই মাশুল বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় চাপটি আসবে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের ওপর, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার কাঁধেই বর্তাবে। শিপিং কোম্পানিগুলো শুরুর দিকেই এই খরচ মেটায় এবং পরে তা আদায় করে নেয় আমদানি-রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মাশুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হতো যদি তা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণ করা হতো। তার মতে, এমনিতেই ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক রপ্তানির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর মাঝে একসঙ্গে মাশুল বাড়ানো ব্যবসায়ীদের জন্য আরও চাপ তৈরি করবে। তিনি এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান, যেন রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বজায় থাকে এবং ভোক্তার ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে।