
প্রতিবেদক: বাংলাদেশের শিল্প উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ। গত দেড় দশকে এখানকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত ওসমান পরিবার। শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান, এই দুই প্রভাবশালী নেতা গার্মেন্টস, শিপিং, পরিবহন ও আবাসনসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করেছেন, যার মোট সম্পদ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সমান। ২০২২ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই ওসমান পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। বর্তমানে তারা বিদেশে বসে নিজেদের ব্যবসার জন্য নতুন অংশীদার খুঁজছেন।
শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমান আগে থেকেই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের বেনামি অংশীদার ছিলেন, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই গ্রুপে তাদের অংশীদারত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া নতুনভাবে তারা ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এক সদস্যকে যুক্ত করেছেন, যিনি শামীম ওসমানের সঙ্গে গুলশানে বাস করতেন এবং বর্তমানে ওসমান পরিবারের সম্পত্তির দেখভাল করছেন।
অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জের আরেক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম দস্তগীর গাজী, যিনি শেখ হাসিনা সরকারের পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, বর্তমানে কারাগারে আছেন। তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশ কিছু কারখানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কিছু কারখানা আট মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। তার পরিবার ব্যবসা পুনরায় সচল করতে অংশীদার খুঁজছে, তবে স্থানীয় বিএনপির দুটি গ্রুপের মধ্যে তীব্র বিবাদের কারণে এ প্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগোচ্ছে না।
এছাড়া, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-৮ আসনে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন শামীমও ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন। তিনি এসকিউ গ্রুপের কর্ণধার এবং সাবেক ব্যাংক চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিএনপিপন্থী একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সঙ্গে অংশীদার হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও বিদেশে বসে তার মালিকানাধীন রেনেসাঁ গ্রুপের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তার গ্রুপের ব্যবসাগুলো বর্তমানে খারাপ অবস্থায় রয়েছে এবং তিনি বিদেশে থেকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তার পরিবার বর্তমানে বিএনপির রাজশাহী অঞ্চলের নেতাদের সঙ্গে ব্যবসার অংশীদার হওয়ার আলোচনা করছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এখন ব্যবসা পরিচালনা করতে অক্ষম। তাদের অনেকেরই ব্যবসা ঠিকাদারি কেন্দ্রিক ছিল, যা বর্তমানে সম্ভব নয়। বিশেষ করে, বড় বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে সালমান এফ রহমানের মতো কয়েকজনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।
এ পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছেন, অথবা সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও সরকার ও বিএনপি-জামায়াতের রোষানলে পড়ছেন। নতুন করে বিনিয়োগের পরিবেশও দেশের মধ্যে নেই।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকার দেড় দশক বেশি সময়ে দলের নেতারা যেমন রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন, তেমনি ব্যবসায়ও নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ২০০৯ সালের শুরুতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হওয়ার পর, আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। নেতাকর্মীরা পেশাদার ব্যবসায়ীদেরও নিজেদের দলে যুক্ত করে এবং জাতীয় নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেয়া হয়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনীত ২৬৫ প্রার্থীর মধ্যে ১৭০ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী, যা মোট প্রার্থীর ৬৪ দশমিক ১৫ শতাংশ।
তবে, এই নেতাদের অনেকের মধ্যে রয়েছে অঢেল সম্পদ। তাদের মধ্যে অন্তত ১৬ জনের আয়কর রিটার্নে ১০০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ঘোষণা ছিল। এর মধ্যে গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজী ১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার মালিক, কুমিল্লা-৮ আসনের আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন ৩৭২ কোটি টাকার সম্পত্তির অধিকারী, এবং এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের সম্পত্তির পরিমাণ ৩০৫ কোটি টাকা।
এছাড়া, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের সম্পত্তি ৩৯৪ কোটি টাকার ছিল। তবে, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে তিনি গ্রেফতার হন এবং বর্তমানে কারাগারে আছেন। তার মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের এক ডজনেরও বেশি কোম্পানি ঋণের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।
চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, যিনি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক, এবং ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা মো. খসরু চৌধুরী, যিনি নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান, তাদের সম্পদও শতকোটি টাকার বেশি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আরও কয়েকজন পলাতক আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ। তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ছিলেন এবং বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়, তিনি ও তার আত্মীয়দের মালিকানায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২৯৫ মিলিয়ন ডলারের ৪৮২টি সম্পত্তি রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ বর্তমানে আরমিট গ্রুপের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন, তবে তিনি এখনো ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে নতুন অংশীদার খুঁজছেন। তার কোম্পানি সেক্রেটারি সৈয়দ কামরুজ্জামান জানান, “দেশে আমরা ব্যবসা দেখাশোনা করছি। স্যার মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে যুক্ত হয়ে কথা বলেন।”
এ ধরনের পরিস্থিতিতে, আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতার কাছে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য অংশীদার খোঁজার খবর সামনে আসছে। তবে, সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণকারী এসব নেতাদের বেশিরভাগই বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই বিদেশে বসে ব্যবসার দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।
ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন আওয়ামী লীগের নেতা–নেত্রীরা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলের অনেক নেতা ব্যবসায়ও সক্রিয় ছিলেন, এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে বেশ কিছু নেতা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অংশীদার খুঁজছেন। এই নেতাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। যদিও তিনি সরাসরি সামনে আসেননি, তবে তার স্ত্রী নুরান ফাতেমা ও দুই ভাই খালেদ মাহমুদ এবং এরশাদ মাহমুদের মাধ্যমে তার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় হাছান মাহমুদের স্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরের শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটরের লাইসেন্স পান। এছাড়া, তার পরিবারটি একাধিক ফিশিং ট্রলারও পরিচালনা করে। সম্প্রতি, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০০ একরের বেশি জমি উদ্ধার হয়েছে, তবে এই ব্যবসাগুলো চলমান রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, স্থানীয় বিএনপির নেতারা তাকে ব্যবসায়িক সহযোগিতা দিচ্ছেন।
এছাড়া, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামও ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন। তিনি রফতানিমুখী পোশাক শিল্প, ব্যাংকসহ বিভিন্ন শিল্প উদ্যোগে জড়িত ছিলেন, যার মধ্যে ফেবিয়ান গ্রুপ নামে একটি পোশাক কারখানা রয়েছে। তবে, তিনি বর্তমানে পলাতক থাকলেও তার সন্তানরা ব্যবসা পরিচালনা করছেন। জানা গেছে, তিনি এখন নতুন অংশীদার খুঁজছেন।
একইভাবে, মাহবুব-উল আলম হানিফও ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন। তার মালিকানাধীন কোয়েস্ট গ্রুপের অধীনে বেশ কয়েকটি খাতে ব্যবসা রয়েছে, যার মধ্যে ঠিকাদারি, ড্রেজিং, ট্রাভেল এজেন্সি, রিসোর্ট, আবাসন, মাছের ঘেরসহ বিভিন্ন উদ্যোগ অন্তর্ভুক্ত।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও ব্যবসায়িক অংশীদার খুঁজছেন। তার জনশক্তি রফতানি, আবাসন, শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। তিনি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন যাতে নিজের ব্যবসা চালু রাখতে পারেন।
বণিক বার্তা এই নেতাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করলেও, বেশিরভাগ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর বন্ধ রয়েছে এবং যারা যোগাযোগে এসেছেন, তারা নিজেদের নাম উদ্ধৃত করতে রাজি হননি।
আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, “যেসব আওয়ামী লীগ নেতা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন বিপদে পড়েছেন। লভ্যাংশ তো দূরের কথা, মূলধনই হারাচ্ছেন। ব্যবসা পরিচালনা না করতে পারলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।” তিনি আরও জানান, ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি আওয়ামী লীগ নেতার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
এছাড়া, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু তার বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনার জন্য অংশীদার খুঁজছেন। তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, নসরুল হামিদ বিপু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। বর্তমানে, তিনি দেশে থাকা বিভিন্ন সম্পদ বিক্রি করছেন এবং যেগুলো বিক্রি করা যাচ্ছে না, সেগুলোর জন্য অংশীদার খুঁজছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
এই নেতাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম এবং অংশীদারিত্বের খোঁজ অব্যাহত রয়েছে, এবং রাজনীতির পাশাপাশি তাদের ব্যবসায়িক পরিস্থিতিও বর্তমানে সংকটাপন্ন।