ভর্তুকি কমছে, দায় কমাতে চায় সরকার

প্রতিবেদক: আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরে সরকার ভর্তুকি ও প্রণোদনার জন্য এক লাখ ২৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে অর্থনীতির সংকটময় পরিস্থিতিতে এই বরাদ্দ রাজস্ব আদায়ে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও এই বরাদ্দ ২০২৪–২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় নয় শতাংশ বেশি, তবে তা সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১১ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৪১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজস্ব আহরণ কম হওয়ায় ভর্তুকি বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। সরকার মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিভিন্ন খাতে পুরোনো বকেয়া পরিশোধে উচ্চ বরাদ্দ প্রয়োজন হলেও বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। নতুন বরাদ্দের বড় একটি অংশ বিদ্যুৎ, সার ও খাদ্য খাতে ব্যয় করা হবে।

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ২০২৫–২৬ অর্থবছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার কোটি টাকায়। আগের সরকার সময়মতো পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বকেয়া বেড়েছিল। এখন সেগুলো পরিশোধ করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি ও এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে। তবে বর্তমান সরকার পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন না করে ভবিষ্যতের বোঝা কমানোর কৌশল নিচ্ছে।

এছাড়া, চলতি অর্থবছরে এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বেড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ইউনিট এলএনজি কেনা ও বিক্রির মধ্যে ব্যবধান প্রায় ১৭ হাজার ৬৭৬ টাকা। কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির শুল্ক কাঠামো পর্যালোচনা করছে। ইতোমধ্যে নেপালের সঙ্গে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিও হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই রূপপুর প্রকল্প থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে। এতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ কিছুটা হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ আগামী অর্থবছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে, যা চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ২৫ হাজার কোটি টাকা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার আধুনিক যন্ত্র ও সার ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।

খাদ্য ভর্তুকি ৩১ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই অর্থে ওপেন মার্কেট সেলস (ওএমএস), টিসিবি এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ৫০ লাখ উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়িয়ে ৫৩ লাখে উন্নীত করা হবে। প্রতি পরিবারকে প্রতি মাসে ১৫ টাকা কেজিতে ৩০ কেজি করে চাল ছয় মাস দেওয়া হবে, যা আগে দেওয়া হতো পাঁচ মাস।

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনার আওতায় যথাক্রমে ৭ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা ও ৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব রয়েছে। সব মিলিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা হিসেবে ৪২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা এবং নগদ ঋণ হিসেবে ১২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, ভর্তুকি ও প্রণোদনা বছরের পর বছর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, “রপ্তানিমুখী শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি প্রণোদনার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। পরিচালন ব্যয় কমিয়ে সরকার অবদান রাখতে পারে।” তার মতে, বর্তমানে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার কার্যকর থাকায় রেমিট্যান্সে নগদ প্রণোদনা বন্ধ করা উচিত।

২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তরণের লক্ষ্যে সরকার ধাপে ধাপে রপ্তানি প্রণোদনা কমানোর পরিকল্পনা করছে। একই সঙ্গে আরও স্বনির্ভর, বহুমাত্রিক ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।