
অনলাইন ডেক্স: পাহাড়ঘেরা সীতাকুণ্ডের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। চট্টগ্রাম শহর থেকে এই মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যেতে ডান পাশে দেখা যায় একের পর এক ভারী শিল্প কারখানা—সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, ইস্পাত, কনটেইনার ডিপো, গাড়ি সংযোজন, কাচসহ বিভিন্ন কারখানা। আর বাঁ পাশে সাগর উপকূলে চোখে পড়ে পুরোনো জাহাজের ফানেল বা চিমনি, যা দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্পের অবস্থান নির্দেশ করে। মহাসড়কের দুই পাশেই রয়েছে একাধিক এলপি গ্যাস কারখানা। এত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সমাবেশে সীতাকুণ্ডকে বলা হয় ভারী শিল্পের রাজধানী।
চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ২৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় দুই শতাধিক শিল্পকারখানা রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত ১৫০টি ভারী শিল্প। অর্থাৎ, প্রতি দুই বর্গকিলোমিটারে একটি ভারী শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে।
সীতাকুণ্ডে শিল্প স্থাপনের অন্যতম কারণ চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটতা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংযোগ। বন্দর থেকে সহজে কাঁচামাল আনা যায় এবং মহাসড়কের মাধ্যমে দ্রুত পণ্য সারা দেশে সরবরাহ করা সম্ভব। এই সুবিধাগুলোই উদ্যোক্তাদের সীতাকুণ্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী করেছে।
তবে ভারী শিল্প গড়ে ওঠার পরও অনেক অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে:
- উচ্চ পরিবহন ব্যয়: ছয় চাকার ট্রাকে ১৩ টনের বেশি মাল পরিবহন নিষেধ, যা সরবরাহ ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।
- পানির সংকট: গ্লাস, ইস্পাতসহ ভারী শিল্পের জন্য প্রচুর মিঠাপানি প্রয়োজন, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ব্যয়বহুল বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।
- চাঁদাবাজি: এটি বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় একটি সমস্যা।
শিল্পনীতি ২০২২ অনুযায়ী, ভারী শিল্প বলতে বোঝায় বৃহৎ উদ্যোগ, বড় যন্ত্রপাতি, বিশাল জমির ব্যবহার এবং উচ্চ বিনিয়োগ সম্পৃক্ত উৎপাদন কার্যক্রম। এই নীতির আওতায় সীতাকুণ্ডে নিম্নলিখিত শিল্পগুলো গড়ে উঠেছে:
- জাহাজভাঙা শিল্প: ৭৫টি কারখানা
- রড ও ঢেউটিন: ৪৩টি কারখানা
- এলপিজি কারখানা: ৯টি
- বস্ত্রকল: ৫টি
- পেট্রোলিয়াম পরিশোধনাগার: ৪টি
- সিমেন্ট কারখানা: ৩টি
- গাড়ি সংযোজন ও যন্ত্রাংশ উৎপাদন: ৩টি
- গ্লাস ও টাইলস: ২টি
- অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাস উৎপাদন: ১০টি
- পোলট্রি খাত: ১১টি
- ভোগ্যপণ্য: ৬টি
বাংলাদেশের বিলিয়ন ডলার ক্লাবের আটটি শিল্প গ্রুপের মধ্যে তিনটি—আবুল খায়ের, বিএসআরএম ও টি কে গ্রুপ—এর কারখানা সীতাকুণ্ডে অবস্থিত।
সীতাকুণ্ড বর্তমানে দেশের শীর্ষ ভারী শিল্প অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পরিবহন ও অবকাঠামো উন্নয়ন হলে এটি বাংলাদেশের শিল্প উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। উদ্যোক্তারা আশাবাদী, সরকারী নীতি সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে সীতাকুণ্ড দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক হাব হিসেবে গড়ে উঠবে।
সীতাকুণ্ডের শিল্পায়নের অন্যতম প্রধান খাত ইস্পাত শিল্প। এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য ইস্পাত কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- পিএইচপি স্টিল কমপ্লেক্স
- জিপিএইচ স্টিল মিলস
- আবুল খায়ের স্টিল মিলস
- আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং মিলস
- কেএসআরএম
- বিএসআরএম স্টিল
- কে আই ওয়াই স্টিল মিলস
এ ছাড়া সিমেন্ট খাতের উল্লেখযোগ্য কারখানাগুলো হলো—মোস্তফা হাকিম সিমেন্ট,কনফিডেন্স সিমেন্ট,রয়েল সিমেন্ট
সীতাকুণ্ডের শিল্পপ্রবাহ শুধু ইস্পাত ও সিমেন্টেই সীমাবদ্ধ নয়, এখানে রয়েছে আরও বিভিন্ন শিল্প খাত—পিএইচপি গ্লাস ফ্যাক্টরি,বিল্ড কম (টাইলস শিল্প),প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ,আফতাব অটোমোবাইল
সীতাকুণ্ডে অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় জাহাজভাঙা শিল্প অঞ্চল। এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- এইচ এম শিপব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি
- পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ
- এস এন করপোরেশন
- কবির শিপ রিসাইক্লিং
- কে আর শিপ রিসাইক্লিং
- তাহের শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং
- এনবি স্টিল
- যমুনা শিপ ব্রেকার্স
- ফোর স্টার শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ
- এস এইচ এন্টারপ্রাইজ
সীতাকুণ্ডে চারটি বৃহৎ ইস্পাত কোম্পানির কারখানা রয়েছে—
- বিএসআরএম গ্রুপ
- আবুল খায়ের গ্রুপ
- জিপিএইচ গ্রুপ
- কেএসআরএম গ্রুপ
এ ছাড়া রড উৎপাদনের জন্য ৩৩টি সনাতন ও আধা স্বয়ংক্রিয় কারখানা রয়েছে, যা মিলিয়ে প্রায় ৬০ লাখ টন রড উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। তবে ২০২৪ সালে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পরিসংখ্যান অনুসারে, এই অঞ্চলে ৩৩ লাখ টন রড উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশের মোট উৎপাদনের ৫০% এর বেশি।
সারা দেশের ঢেউটিনের কাঁচামাল ও পরিশোধিত ইস্পাত পাতের বড় অংশ আসে সীতাকুণ্ড থেকে। দেশে পরিশোধিত ইস্পাত পাত তৈরির ছয়টি কোম্পানার মধ্যে চারটি সীতাকুণ্ডে অবস্থিত:
- আবুল খায়ের গ্রুপ
- পিএইচপি গ্রুপ
- কেডিএস গ্রুপ
- টি কে গ্রুপ
ঢেউটিনের ৭০% কাঁচামাল এখান থেকে আসে এবং সীতাকুণ্ডই দেশের প্রধান ঢেউটিন উৎপাদন কেন্দ্র।
শীতলপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরে ৭৫০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং মিল।
বিলেট উৎপাদন: আধুনিক ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (EAF) প্রযুক্তিতে স্ক্র্যাপ থেকে বিলেট তৈরি হয়।রড উৎপাদন: নতুন রোলিং ইউনিট সংযোজনের ফলে বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ লাখ টন হয়েছে। তবে বিলেট উৎপাদন সক্ষমতা ২০ লাখ টন।
সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাটে ৩০০ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে আবুল খায়েরের ঢেউটিন কারখানা।
বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ৬ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টনবাজারে শীর্ষ স্থান: আবুল খায়েরের “গরু মার্কা” ঢেউটিন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সীতাকুণ্ড দেশের ভারী শিল্প খাতের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। এখানে ইস্পাত, সিমেন্ট, এলপি গ্যাস, জাহাজভাঙা, কাচ, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শিল্প গড়ে উঠেছে। সুষ্ঠু অবকাঠামো ও নীতি সহায়তা পেলে এটি দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প হাব হিসেবে আরও বিকশিত হবে।
সুত্র:প্রথম আলো