ভালো কোম্পানির শেয়ারের অবমূল্যায়নেও নেই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ

প্রতিবেদক: শেয়ারবাজার নিয়ে একটি প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে—শেয়ারের দামই বিনিয়োগকারী টানে। অর্থাৎ শেয়ারের দাম যখন কমে, তখন সাধারণত বিনিয়োগকারীরা বাজারমুখী হন। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজারে চিত্রটি উল্টো। ভালো মানের কোম্পানির শেয়ারের দাম ঐতিহাসিকভাবে কম হলেও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ তেমন নেই। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার একটি বড় সংকেত পাওয়া যাচ্ছে।

শেয়ারবাজার বিশ্লেষণে ‘মূল্য আয় অনুপাত’ বা পিই রেশিওকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পিই রেশিও কম মানে ঝুঁকি কম এবং বিনিয়োগের অর্থ দ্রুত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অথচ বর্তমানে ডিএসই–৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত ৩০টি ভালো মানের কোম্পানির মধ্যে ১৬টিরই পিই রেশিও ১০-এর নিচে। এদের মধ্যে ৮টি কোম্পানির পিই রেশিও ৫-এর নিচে। স্বাভাবিকভাবে এই অবস্থায় এসব কোম্পানির শেয়ারের প্রতি উচ্চ চাহিদা থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে উল্টোটা ঘটছে। গত রোববার এই ১৬ কোম্পানির মধ্যে ১৫টিরই দরপতন হয়েছে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, পিই রেশিও সবচেয়ে কম প্রাইম ব্যাংকের, মাত্র ২.৯৫। এরপর রয়েছে পদ্মা অয়েল (৩.৩৫), যমুনা অয়েল (৩.৫৮), বিএসআরএম (৩.৮২), পূবালী ব্যাংক (৩.৯৪), মেঘনা পেট্রোলিয়াম (৪.০১), বিএসসি (৪.৬০) এবং ইস্টার্ন ব্যাংক (৪.৯৮)। এত কম পিই রেশিওর মানে হলো—বর্তমান মুনাফার ধারা অব্যাহত থাকলে মাত্র ৩-৪ বছরে বিনিয়োগের অর্থ উঠে আসতে পারে। তবু বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত।

বিশ্লেষক মোহাম্মদ মুসা মনে করেন, বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত হওয়ার দুটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাজার নিয়ে তাদের আস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, যেসব কোম্পানির পিই রেশিও সবচেয়ে কম, তাদের আর্থিক প্রতিবেদনের সত্যতা নিয়েই সংশয় আছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের ক্ষেত্রে এই অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন, ব্যাংকগুলোর প্রকাশিত মুনাফা প্রকৃত অবস্থাকে প্রতিফলিত করে না।

বর্তমানে পিই রেশিও সবচেয়ে কম ব্যাংক, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, সেবা ও আবাসন, বস্ত্র এবং সিমেন্ট খাতে। ব্যাংক খাতের ৩৬টি কোম্পানির গড় পিই রেশিও মাত্র ৫.৪৫। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ২৩ কোম্পানির গড় ৫.৬২। সেবা ও আবাসন খাতের ৪ কোম্পানির গড় ৮.৮৮। বস্ত্র খাতের ৫৮ কোম্পানির গড় ৯.৩৮ এবং সিমেন্ট খাতের ৭ কোম্পানির গড় ৯.৭৬। তবুও এসব খাতে বিনিয়োগকারীদের সাড়া নেই।

বিশ্ববিখ্যাত বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট পরামর্শ দেন, কম দামে সাধারণ মানের কোম্পানির শেয়ার কেনার চেয়ে ন্যায্য দামে ভালো কোম্পানির শেয়ার কেনাই বেশি লাভজনক। অথচ দেশের শেয়ারবাজারে এই নীতির চর্চা খুবই সীমিত। ভালো কোম্পানির শেয়ার কম দামে পাওয়া গেলেও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছেন, বরং অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ বা কারসাজির আশ্রয়ে থাকা শেয়ারে দৌড়াচ্ছেন। ফলে বাজারে লেনদেন কমছে, সূচকও নিচে নেমে যাচ্ছে।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ভালো কোম্পানির শেয়ার অবমূল্যায়িত থাকলেও তাতে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ নেই। এটি বাজারের প্রতি আস্থাহীনতার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। দীর্ঘদিনের পতনে বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। এখন তাদের প্রধান লক্ষ্য লোকসান কমিয়ে বাজার থেকে সরে যাওয়া। এ কারণে ভালো শেয়ারও অন্যায্য অবহেলার শিকার হচ্ছে।

সার্বিকভাবে, দেশের শেয়ারবাজারে পিই রেশিওর মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে না পারলে ভালো শেয়ার কম দামে থেকেও বাজার চাঙ্গা করার শক্তি পাবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো অর্থনীতি এবং বিনিয়োগ সংস্কৃতি।