ভূরাজনীতি, অর্থনীতি ও জলবায়ু সংকটে জটিল সময় পার করছে বিশ্ব: আইসিসিবি

প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) জানিয়েছে, বিশ্ব বর্তমানে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, জলবায়ু ঝুঁকি এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতায় এক জটিল সময় অতিক্রম করছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য ২০২৫ সাল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের বছর হতে চলেছে। তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই কৌশলগত প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

আজ শনিবার ঢাকায় আইসিসিবির ৩০তম বার্ষিক কাউন্সিলে এসব কথা বলা হয়। কাউন্সিলে সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান এক বিশদ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন, যাতে বৈশ্বিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং তার বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব তুলে ধরা হয়।

কাউন্সিলে বলা হয়, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, লোহিত সাগরে সংকট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদের প্রবণতা বেড়েছে। এসব কারণেই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। চলতি ২০২৫ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২.৮ শতাংশে নেমে আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ এবং রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

বিশ্বব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। আইএমএফ ও এডিবির অনুমান অনুযায়ী, এ হার যথাক্রমে ৩.৮ ও ৩.৯ শতাংশ হতে পারে।

আইসিসিবি মনে করে, বিনিয়োগ হ্রাস এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে। একইসঙ্গে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরও উদ্বেগজনক। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেশের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যার বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। ১৯টি ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ফলে সরকার কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন ব্যাংকের বোর্ড বাতিল, একীভূতকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ জোরদার।

২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। এতে তৈরি পোশাক খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যে পণ্য রপ্তানিতে সর্বোচ্চ ১১.৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতে পারে। তাই আইসিসিবি রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে একটি কার্যকর উত্তরণ কৌশল গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ওষুধ, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।

কাউন্সিলে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়।

জ্বালানি নিরাপত্তা বৈদেশিক জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ও মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় ব্যয় বেড়েছে। এর সমাধানে ঘরোয়া অনুসন্ধান এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি।

রাজস্ব ঘাটতি জিডিপির তুলনায় কর আহরণ মাত্র ১০ শতাংশেরও কম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।

জলবায়ু ও খাদ্যনিরাপত্তা বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।

বিনিয়োগ ও রপ্তানি বৈচিত্র্য ২০২৩ সালে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ভিয়েতনামে তা ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার।

সাইবার নিরাপত্তা ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার হুমকিও বাড়ছে। দ্রুত জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো ও আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শুল্ক মার্কিন আমদানি শুল্ক ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি পোশাক খাত ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

আইসিসিবি বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) করিডরের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনার মাধ্যমে জানায়, ২০৩৫ সালের মধ্যে সম্মিলিত জিডিপি ৮ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৌশলগত একটি ট্রানজিট হাবে পরিণত হতে পারে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান। উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি নাসের এজাজ বিজয়, নির্বাহী সদস্য মীর নাসির হোসেন, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, আনোয়ার-উল-আলম পারভেজ, আফতাব উল ইসলাম, মহাসচিব আতাউর রহমান, বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, ডিসিসিআইর সহসভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী, এফআইসিসিআই সভাপতি জাভেদ আখতার, এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি. রহমান, বিআইএর সভাপতি সাঈদ আহমেদ এবং বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান।

এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রুনাই দারুসসালামের হাইকমিশনার হাজি হারিস বিন হাজি ওসমান, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত ইউ কিয়াও সোয়ে মোয়ে, আর্জেন্টিনার চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ম্যাক্সিমিলিয়ানো রোমানেলো এবং এডিবির সিনিয়র ইকোনমিক অফিসার বরুণ কুমার দে।

সভায় আইসিসিবি সভাপতি মাহবুবুর রহমান জানান, তাঁদের সংগঠন তিনটি ভিত্তিকে গুরুত্ব দিয়ে টেকসই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে কাজ করে যাবে—সংস্কার, সহনশীলতা ও আঞ্চলিক সংযুক্তিকরণ।