মধ্যবিত্ত ও অবসরপ্রাপ্তদের জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ

প্রতিবেদক: মধ্যবিত্ত ও অবসরপ্রাপ্তদের জন্য সঞ্চয়পত্র একটি নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। তবে বিনিয়য়ের আগে পরিকল্পনা ও সচেতনতা খুবই জরুরি। শুধু বেশি সুদের হার দেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না করে বরং নিজের প্রয়োজন, সময়, করহার ও ভবিষ্যৎ লক্ষ্য মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এতে বিনিয়োগ যেমন নিরাপদ থাকবে, তেমনি তা থেকে কাঙ্ক্ষিত লাভও পাওয়া যাবে।

সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর হয়ে থাকে। তাই যদি আপনি স্বল্প সময়ের মধ্যে টাকা তুলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন, তাহলে সঞ্চয়পত্র আপনার জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ, নির্ধারিত মেয়াদের আগেই সঞ্চয়পত্র ভাঙালে মুনাফার হার কমে যায়। বর্তমান সময়ে দেশে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত, তবে সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে ধাপে ধাপে সুদের হার কমে যেতে পারে। এ ছাড়া মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয় এবং যদি কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) না থাকে, তাহলে করহার বেড়ে হয় ১৫ শতাংশ। পাঁচ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে কর কাটা হয় না।

বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে ১০ শতাংশের বেশি রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা পাওয়া যায়, তা প্রকৃত অর্থে লাভ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে আপনার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসও পেতে পারে। তাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরাপদ হলেও সব সময় তা লাভজনক নাও হতে পারে। মূল্যস্ফীতির এই বাস্তবতা অবশ্যই বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে সরকারের নির্ধারিত সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন, পরিবার সঞ্চয়পত্র শুধু নারীরা কিনতে পারেন এবং সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারেন। ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে এককভাবে ৩০ লাখ এবং যৌথভাবে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সরকারি অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারেন। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রেও একই সীমা প্রযোজ্য।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে হলে কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা ও কাগজপত্র থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশি নাগরিক, অভিবাসী বাংলাদেশি এবং সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরা নির্দিষ্ট শর্তে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন। বিদেশে থাকা প্রবাসীরাও নির্ধারিত নিয়মে বিনিয়োগ করতে পারবেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট সাইজ ছবি, ব্যাংক হিসাব নম্বর, টিআইএন সার্টিফিকেট (যদি থাকে) এবং অর্থের উৎস (যেমন বেতন স্লিপ বা আয়কর বিবরণী)।

২০২১ সাল থেকে সরকার অনলাইন নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করেছে। এখন আর অনলাইন নিবন্ধন ছাড়া কেউ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। এজন্য Digital National Savings System (DNSS)-এ নিবন্ধন করতেই হবে। সঞ্চয়পত্র কেনার সময়ই একটি ব্যাংক হিসাব নম্বর দিতে হয়, কারণ সেই হিসাবেই মুনাফার টাকা জমা হয়। তাই আগে থেকেই ব্যাংক হিসাব খোলা থাকা প্রয়োজন।

বিনিয়োগের সময় আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, তা হলো—জরুরি অর্থের প্রয়োজন হতে পারে। আপনার সব টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা থাকলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে অসুবিধায় পড়তে পারেন। কারণ, নির্ধারিত সময়ের আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙালে মুনাফা কমে যায়। তাই বিনিয়োগের পাশাপাশি কিছু নগদ অর্থ নিজের কাছে রাখা উচিত।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কখনোই দালাল বা ব্যক্তিগত চ্যানেলের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র কিনবেন না। এতে আপনার টাকা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। নিরাপদ লেনদেনের জন্য ডাকঘর, বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা নির্ধারিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমেই সঞ্চয়পত্র কিনুন।

সঠিক পরিকল্পনা, প্রয়োজনীয় তথ্য ও সুরক্ষিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে সঞ্চয়পত্র আপনার ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার জন্য একটি শক্ত ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।