
প্রতিবেদক: বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে শিক্ষাবিমার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আগে এই শ্রেণির মানুষ বিমার প্রতি অনাগ্রহী থাকলেও এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ শিক্ষার বিষয়ে বাড়তি সচেতনতা এবং শিক্ষার ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে অনেকেই এখন শিক্ষাবিমার দিকে ঝুঁকছেন।
পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু বা বড় কোনো আর্থিক বিপদের কারণে অনেক সময় সন্তানের পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাবিমা একটি কার্যকর আর্থিক নিরাপত্তা হিসেবে কাজ করে। এটি নিশ্চিত করে, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পরেও সন্তানের পড়াশোনায় ব্যাঘাত না ঘটে এবং নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া যায়।
শিক্ষাবিমার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সঞ্চয় ও নিরাপত্তা দুটোই প্রদান করে। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত প্রিমিয়াম পরিশোধের পর মেয়াদ শেষে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পাওয়া যায়, যা সন্তানের শিক্ষার খরচে ব্যবহার করা যায়। বিমাধারীর মৃত্যু হলেও পলিসি বহাল থাকে এবং বাকি প্রিমিয়াম মওকুফ হয়। ফলে পরিবারে বড় কোনো বিপর্যয় এলেও সন্তানের পড়াশোনার অর্থ থেমে থাকে না।
এই বিমার আওতায় পাওয়া অর্থ এককালীন বা ধাপে ধাপে দেওয়া হতে পারে। কেউ মেয়াদ শেষে পুরো টাকা একবারে পান, আবার কেউ ধাপে ধাপে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে টাকা পান। অনেক ক্ষেত্রে বার্ষিক ভাতা হিসেবেও অর্থ দেওয়া হয়। এছাড়া, এই বিমায় বিনিয়োগ সুবিধাও থাকে, তাই এটিকে এক ধরনের আর্থিক বিনিয়োগ হিসেবেও ধরা যায়।
সাধারণত ১২ বছর বয়স পর্যন্ত কোনো শিশুর জন্য শিক্ষাবিমা নেওয়া যায়। এর মেয়াদ ১০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। মাসিক এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে যে–কেউ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রিমিয়াম নির্ধারণ করতে পারেন।
দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষাবিমা সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি জীবন বীমা করপোরেশন, বেসরকারি ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স এবং মেটলাইফ ইনস্যুরেন্স অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানে বাবা-মা পলিসিধারী হিসেবে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত প্রিমিয়াম জমা দেন। মেয়াদ শেষে সন্তানের শিক্ষার জন্য এককালীন অর্থ দেওয়া হয়। অভিভাবকের মৃত্যু হলে বাকি প্রিমিয়াম মওকুফ হয় এবং নির্ধারিত সময়ে পুরো অর্থ সন্তানের নামে পরিশোধ করা হয়।
ডেল্টা লাইফ ইনস্যুরেন্স জানিয়েছে, মেয়াদ শেষে বা পলিসিধারীর মৃত্যু হলে চার মাস পরপর বার্ষিক ভাতা দেওয়া হয়, যার পরিমাণ প্রতিবছর ৭ শতাংশ হারে বাড়ে। এতে সন্তানের শিক্ষার খরচের সঙ্গে সময়োপযোগী সামঞ্জস্য বজায় থাকে।
অন্যদিকে, মেটলাইফ শিক্ষাবিমার আওতায় অভিভাবকের মৃত্যু হলে তিনটি সুবিধা দেয়: বিমার পুরো টাকা এককালীন দেওয়া হয়, পলিসি চালু থাকে এবং প্রতি মাসে বিমা অঙ্কের ২ শতাংশ করে সন্তান পায়, যা মেয়াদপূর্তির সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
শিক্ষাবিমা করতে চাইলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অফিসে যাওয়া ভালো। তবে অনেকেই বিমা প্রতিনিধির মাধ্যমেও এটি করেন। সব ধরনের লেনদেন অ্যাকাউন্ট পেই চেক বা ব্যাংক লেনদেনের মাধ্যমে করা নিরাপদ। এখন অনেক কোম্পানি ই-প্রিমিয়ামের সুবিধা দিচ্ছে, যার ফলে ঘরে বসেই প্রিমিয়াম পরিশোধ করা যাচ্ছে বিকাশ, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। বিভিন্ন কোম্পানির ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রিমিয়াম ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে নিজের পলিসির সম্ভাব্য হিসাবও জানা যায়।
তবে শিক্ষাবিমা করার সময় কিছু বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেমন—কোম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতা, পলিসির ধরন, সুবিধা, প্রিমিয়ামের পরিমাণ, পরিশোধ পদ্ধতি, রিটার্ন ও অতিরিক্ত সুবিধা। শুধু বিমা প্রতিনিধির কথায় বিশ্বাস না করে নিজে পড়ে বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। নথিপত্র না পড়ে স্বাক্ষর করা, নমিনির তথ্য ফাঁকা রাখা—এ ধরনের ভুল এড়াতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিমা আর ব্যাংক সঞ্চয়ের পার্থক্য বুঝে নেওয়া। ব্যাংকে আপনি সঞ্চয় ও মুনাফা পাবেন, কিন্তু মৃত্যু বা দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো সুরক্ষা পাবেন না। কিন্তু বিমা একই সঙ্গে সঞ্চয় ও নির্দিষ্ট ঘটনার আর্থিক নিরাপত্তা দেয়। তাই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে শিক্ষাবিমা হতে পারে এক টেকসই আর্থিক সিদ্ধান্ত।