
নিজস্ব প্রতিবেদেক: বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীরা যখন শুধু পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন, তখনই আর কে হান্নান ই-কমার্সের মাধ্যমে চামড়ার তৈরি পণ্য বিক্রি শুরু করেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়াপণ্য সংগ্রহ করে তিনি অনলাইনে বিক্রি করতেন। এভাবেই একসময় নিজেই চামড়ার জ্যাকেট তৈরির উদ্যোগ নেন। মাত্র ৩০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা সেই উদ্যোগ আজ প্রায় অর্ধকোটি টাকার ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই ব্যবসার প্রতি আগ্রহী ছিলেন আর কে হান্নান। কিন্তু তাঁর বাবা-মা চাইতেন তিনি সরকারি চাকরি করুন। তবে তিনি নিজের লক্ষ্য ঠিক রেখে উচ্চমাধ্যমিকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর জীবনের বাঁকবদল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে (২০১০ সালে) তিনি নিজেই একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট তৈরি করেন এবং রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়াপণ্য সংগ্রহ করে বিক্রি শুরু করেন। ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেলেও ব্যবসা তখনও সীমিত পর্যায়ে ছিল।
২০১৪ সালে স্নাতক শেষ করার পর তিনি নিজেই চামড়ার পণ্য তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তবে এটি সহজ ছিল না, কারণ কমপক্ষে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল। এত বড় পুঁজি না থাকায় তিনি মাত্র ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করেন।
প্রথমে তিনি হাজারীবাগের একজন দক্ষ কারিগর এবং একজন সহকারী নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে চুক্তি ছিল—বিক্রি হলে বেতন পাবেন, না হলে নয়। রাজধানীর লালকুঠি এলাকায় একটি ছোট্ট ভাড়া দোকানে চামড়ার জ্যাকেট তৈরির কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে চাহিদা বাড়তে থাকলে এক বছরের মধ্যে ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি।
‘র্যাভেন’ নামকরণের পেছনেও রয়েছে একটি গল্প। গ্রিক মিথলজি এবং এডগার অ্যালেন পোর কবিতা ‘র্যাভেন’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হান্নান এই নামটি বেছে নেন।
জ্যাকেটের চাহিদা বাড়লেও উৎপাদনের জন্য জায়গার সংকট ছিল। তাই ২০১৬ সালে তিনি কারখানাটি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর গ্রামে স্থানান্তর করেন। তবে নতুন সমস্যা দেখা দেয়—দক্ষ শ্রমিকের অভাব। এ সমস্যা সমাধানে তিনি গ্রামের ২০ জন নারীকে এক বছরের প্রশিক্ষণ দেন এবং ২০১৭ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে উৎপাদন শুরু হয়।
২০১৭ সালেই তিনি মিরপুর-১ নম্বরে প্রথম বিক্রয়কেন্দ্র (শোরুম) চালু করেন। এটি ছিল তাঁর জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ, কারণ গ্রাহক পাওয়া, কর্মীদের বেতন দেওয়া ও বিক্রয় কৌশল নির্ধারণ করা বেশ কঠিন হয়ে ওঠে। তবুও তিনি স্বচ্ছতা ও সততার নীতিতে ব্যবসা চালিয়ে যান।
প্রথম দুই-তিন বছর উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি না হলেও, ২০২১ সালে তিনি আবার ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়ান। ওই বছর চট্টগ্রামের খুলশী ও ঢাকার উত্তরায় নতুন দুটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু করেন।
বর্তমানে ‘র্যাভেন’ শুধু চামড়ার জ্যাকেটই নয়, অফিস ব্যাগ, জিম ব্যাগ, ওয়ালেট, গ্লাভস প্রভৃতি চামড়াজাত পণ্য তৈরি করে। তাঁদের তৈরি জ্যাকেটের দাম ১১,৫০০ থেকে ২৩,৫০০ টাকার মধ্যে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২০ জন নিয়মিত কর্মী এবং কিছু অস্থায়ী কর্মী কাজ করছেন।
এ পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকার মতো বিনিয়োগ হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক গড় আয় ৬৫ লাখ টাকা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যবসায়ের খরচ ৩০-৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর কে হান্নান মনে করেন, দেশের চামড়ার জ্যাকেটের বাজার এখনো ছোট, তবে সম্ভাবনাময়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে এই খাতের প্রসার ঘটবে, তবে নিয়মিত অর্থায়ন ও নীতিসহায়তা প্রয়োজন।
এই সফল উদ্যোক্তার মতে, ব্যবসায়িক সাফল্যের মূলমন্ত্র হলো—লক্ষ্য স্থির রাখা, পরিশ্রম করা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা। তার মতে, উদ্যোক্তারা যদি নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখেন এবং সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে যান, তাহলে সফলতা সম্ভব।