
অনলাইন ডেক্স: অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকারে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি ও সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চাপ থাকবেই, তবে এর মধ্যেই কাজ করে যেতে হয়। বিশেষ করে দেশের এই সংকটময় সময়ে সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চেষ্টা করছে। আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
মূল্যস্ফীতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি দীর্ঘদিন ধরে চললেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কমেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা হ্রাস পেলেও তা এখনও সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। দেশে ও বৈশ্বিকভাবে চাহিদা-সরবরাহের তারতম্যের কারণেই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যাংক ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
সরবরাহ সংকটের কারণ বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা ও অতিবৃষ্টির ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় কৃষিপণ্য উৎপাদনে ধাক্কা লেগেছে। ফলে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহে অসুবিধা তৈরি হয়েছে। তবে বর্তমানে সবজির সরবরাহ মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও চালের দাম এখনো চাপে আছে। সংকট মোকাবিলায় সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে চাল, ডাল, মসুর ও গম আমদানি করছে।
রমজানে সাধারণ মানুষের সহায়তায় ট্রাক সেল পুনরায় চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। আগে এটি বন্ধ রাখা হয়েছিল, তবে রমজানের আগে পুনরায় চালু করা হবে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে ট্রাক সেলের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণের ব্যবস্থা করা হবে, যাতে নিম্নবিত্তরা কিছুটা স্বস্তি পায়।
মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হিসেবে চাঁদাবাজির বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশে খাদ্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নানা স্তরে চাঁদাবাজির কারণে দাম বেড়ে যায়। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য থেকে শুরু করে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত একাধিক পর্যায়ে চাঁদা দিতে হয়, যা মূলত বাজারে দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক সরকারের মতো নয়, যার স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় কর্মী বা সংগঠন থাকে। বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের সংস্থাগুলো কাজ করলেও তাদের সংখ্যাগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন বাজারে স্থানীয় গোষ্ঠীর প্রভাব থাকায় ব্যবসায়ীরা চাপে পড়ছেন, যার প্রভাব ভোক্তাদের ওপরও পড়ছে।
শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতা ও বিনিয়োগ সংকট নিয়েও কথা বলেন ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, দেশে শিল্পের প্রসার আশানুরূপ হয়নি। শিল্প খাতে ইউনিট সংখ্যা বেড়েছে, তবে উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধির হার আশানুরূপ নয়। এর পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট ও বিনিয়োগের অভাবকে দায়ী করেন।
বর্তমানে অর্থায়ন সীমিত থাকায় ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ পুনর্গঠন প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটও উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সময়মতো ঋণ পরিশোধে অসুবিধা হওয়ায় নতুন ঋণ পেতে সমস্যা হচ্ছে, যা শিল্প খাতে স্থবিরতা তৈরি করেছে।
অর্থ উপদেষ্টা আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, সুসংগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে গতিশীল করার চেষ্টা চলছে। স্থানীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সরকারের মতো নয়, যার স্থানীয় পর্যায়ে নিজস্ব কর্মী ও সংগঠন থাকে। রাজনৈতিক সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে, কিন্তু বর্তমান সরকারে সেই ব্যবস্থাপনা নেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থার লোকবল সীমিত হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাজার ব্যবস্থায় চাঁদাবাজির বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারওয়ান বাজার, পুরান ঢাকা ও শ্যামবাজারের মতো স্থানে স্থানীয় কিছু গোষ্ঠী অহেতুক সমস্যা সৃষ্টি করে, যা কৃষক ও ভোক্তা—উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। ফলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে দামের কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ সরু চালের দাম কিছুটা বেড়েছে, যদিও মোটা ও মধ্যম মানের চালের দাম তুলনামূলক স্থিতিশীল রয়েছে।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান নিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের বাজেটের ওপর চাপ স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে। কারণ নতুন আয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিসর সংকুচিত হওয়ায় বড় প্রকল্প ও কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে।
জ্বালানি সংকটের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাত মোটামুটি স্থিতিশীল রাখা গেলেও গ্যাস সরবরাহে সমস্যা রয়ে গেছে। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহারের চেষ্টা করা হলেও তা এখনো পর্যাপ্ত নয়।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার পর বড় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ দেশ ছেড়েছেন বা ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন, যা কর্মসংস্থান সংকটে প্রভাব ফেলেছে। আয় বৃদ্ধি না হলে মানুষের সামগ্রিক ব্যয়ভার সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার মেগা প্রকল্পের পরিবর্তে স্থানীয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামো উন্নয়ন হলে কর্মসংস্থান বাড়বে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
দেশের শিল্পখাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, শিল্প উৎপাদনের ইউনিট সংখ্যা বেড়েছে, তবে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি আসেনি। বাংলাদেশ এখনও শক্তিশালী শিল্পভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি, ফলে শিল্পখাতে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি।
ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঋণ পুনর্গঠন প্রয়োজন। ব্যাংক ঋণের অভাবের কারণে ব্যবসার গতি কমে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থায়ন করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হলে সুসংগঠিত পরিকল্পনার প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও গ্যাস সংকট রয়ে গেছে। এনার্জির বিকল্প ব্যবস্থার চেষ্টা করা হচ্ছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুটা সহায়ক হতে পারে। তবে ব্যবসায়ীরা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় নতুন ঋণ পেতেও সমস্যায় পড়ছেন, যা শিল্পখাতে স্থবিরতা সৃষ্টি করছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। সঠিক পদক্ষেপ নিলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে এবং অর্থনীতি আবারও স্বাভাবিক গতিতে ফিরবে।
সূত্র : নিউজ টোয়েন্টিফোর।