
প্রতিবেদক: দেশে দীর্ঘ সময় পর মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে, যা জনজীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরিয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিক (এপ্রিল-জুন) সময়ে সবজির দাম কমে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে আশানুরূপ হ্রাস এসেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমায় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে, যাঁদের ব্যয়ের বড় অংশ খাদ্য কিনতেই চলে যায়। তবে মূল্যস্ফীতি কমলেও মজুরি বাড়েনি—এই দিক থেকে এখনো উদ্বেগ রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার নেমে এসেছে ৮.৪৮ শতাংশে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ওই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৩৯ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯.৩৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চতুর্থ প্রান্তিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য ও জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের অবদান বেড়েছে। এই প্রান্তিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গড় ভূমিকা ছিল ৪৩.৩ শতাংশ, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪৫.৩ শতাংশ।
সবজির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে। সবজির অবদান তৃতীয় প্রান্তিকে যেখানে ছিল ১৪.১ শতাংশ, সেখানে চতুর্থ প্রান্তিকে তা কমে দাঁড়ায় ৪.১ শতাংশে। শস্যজাতীয় খাদ্যদ্রব্য এই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সর্বোচ্চ ৪৩.৭ শতাংশ অবদান রেখেছে। আমিষজাতীয় খাদ্যের প্রভাব কিছুটা কমেছে, কারণ সেগুলোর দাম কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
তবে চতুর্থ প্রান্তিকের শেষদিকে আবার কিছু খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ে—বিশেষ করে সোনালি মুরগি, চাল, সয়াবিন তেল ও মসুর ডাল। জুনে সোনালি মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা প্রভাব পড়ে বাজারে। অন্যদিকে আলু, পেঁয়াজ ও কাঁচা মরিচের দাম ছিল তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল।
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে কাপড় ও জুতার দাম সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। এসব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অবদান ছিল ১৭.৮ শতাংশ এবং জ্বালানির অবদান ছিল ১৪.৬ শতাংশ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতে দাম প্রায় একই রকম ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, মৌসুমি সরবরাহ ও বাজারে কারসাজির সুযোগ কম থাকায় দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে বর্ষাকাল ও সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি মাথায় রেখে আগেভাগেই নীতিগত প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি উচ্চ অবস্থানে থাকলেও, মজুরি বৃদ্ধির হার সে তুলনায় ছিল কম। এর ফলে বাস্তব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করলে মজুরি ও মূল্যস্ফীতির ব্যবধান কিছুটা হ্রাস পায়।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৯ শতাংশ, আর একই সময়ে গড় মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৮.২ শতাংশ। এতে করে পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মজুরি বৃদ্ধির হার এখনো কম এবং এর ইতিবাচক প্রভাব সীমিত।
চতুর্থ প্রান্তিকের শুরুতে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও প্রান্তিকের শেষ দিকে এসে মজুরি বৃদ্ধির হার আবারও স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিভাগভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি মজুরি বেড়েছে রংপুর বিভাগে।
সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির এই কমার ধারা আশার আলো দেখালেও এটি টেকসই করতে হলে নীতিগত সমন্বয়, বাজার তদারকি এবং মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।