
প্রতিবেদক: চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল—সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষকে বেশি খরচ করে খাবার কিনতে হচ্ছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, যার ফলে সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে দারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ১০ মাস মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। বর্তমানে তা ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বেশি থাকায় সীমিত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। সংসার চালাতে অনেকে ধারদেনা করছেন।
মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে দারিদ্র্যসীমার ঠিক ওপরে থাকা মানুষ আবার গরিব হয়ে পড়ে—এমন আশঙ্কা থাকে। বিশ্বব্যাংক বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে ২০২৫ সালে আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী সোমবার ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের আশা, এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ থাকবে।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। তারা কম খায়, কম কেনে—একে বলা যায় ‘নেতিবাচকভাবে মানিয়ে নেওয়া’। তবে এখন যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা দীর্ঘমেয়াদি, যা মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলছে। তিনি আরও বলেন, ‘কোভিড-১৯–এর সময় অনেকেই গরিব হয়ে গেছেন। এরপর বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই, তরুণেরা কাজ পাচ্ছেন না। তার ওপর আবার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
মূল্যস্ফীতির চাপ নতুন নয়। গত আওয়ামী লীগ সরকারও এটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল। অনেক সময় সরকার মূল্যস্ফীতি সমস্যা স্বীকারই করেনি, ফলে তা আরও জটিল হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির উত্তরাধিকার পেয়েছে।
গত ৭-৮ মাসে ডলার সংকট কিছুটা কমেছে, যার ফলে আমদানিতে স্বাভাবিকতা ফিরেছে। তবুও মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিতভাবে কমছে না। বাজার তদারকির অভাব ও চাঁদাবাজির মতো কারণও দায়ী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অভ্যন্তরীণ বাজার কঠোর তদারকির মাধ্যমে দেশীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। একইসঙ্গে গরিব মানুষদের জন্য নগদ ও খাদ্যসহায়তা জরুরি।
মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার সুদের হার বাড়িয়েছে এবং এনবিআর শুল্ক-কর কমিয়েছে। আমদানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা হয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে চাঁদাবাজি বন্ধ না হওয়ায় সুফল মিলছে না বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ।
বিবিএসের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাদের মতে, সরকার বাস্তব চিত্রের চেয়ে কম দেখাচ্ছে। যদিও বর্তমান নীতিনির্ধারকেরা দাবি করছেন, এখন যথাযথ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। পরবর্তী চার মাস (এপ্রিল পর্যন্ত) তা ৯ শতাংশের ঘরে ছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এটি দাঁড়ায় ১৪.১০ শতাংশে—গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি পুরো সময়জুড়ে ৯ শতাংশের ঘরে ছিল।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, মোটা চালের দাম এক বছরে ৫ শতাংশ বেড়েছে। এখন কেজি প্রতি মোটা চাল ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। অন্যান্য চালের দাম ১০-১১ শতাংশ বেড়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বলছে, মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান ২০ শতাংশ—এককভাবে সর্বোচ্চ।
ভোজ্যতেলের দাম ১২ থেকে ২২ শতাংশ বেড়েছে। পেঁয়াজ ও রসুনের দাম ওঠানামা করেছে। ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৬০–১৭০ টাকায় উঠেছে। মাছ, মাংসের দামও ৫-১০ শতাংশ বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি এক ধরনের কর। পণ্যের দাম বাড়লেও মজুরি না বাড়লে মানুষকে ব্যয় কমাতে হয় অথবা ধার করতে হয়। বিবিএস বলছে, গত এক বছরে (মে ২০২৪–এপ্রিল ২০২৫) গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.২১ শতাংশ। কিন্তু কোনো মাসেই মজুরি বৃদ্ধি ৯ শতাংশ ছাড়ায়নি।
বিবিএস অনুযায়ী, ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যাদের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। এই শ্রেণির মানুষ বেশি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ৭.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯.৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এর পেছনে প্রধান তিনটি কারণ: প্রকৃত আয়ের পতন, দুর্বল শ্রমবাজার ও অর্থনৈতিক মন্থরতা।
বিবিএসের ২০২২ সালের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ অনুসারে, দেশের দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ। গ্রামে ২০.৩ শতাংশ এবং শহরে ১৭.৭ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্য হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।