
প্রতিবেদক: চার দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের কোটাসুবিধা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল চট্টগ্রামের তৈরি পোশাক শিল্প। তখনকার তরুণ উদ্যোক্তা মোহাম্মদ আবদুস সালামের নেতৃত্বে এশিয়ান গ্রুপের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের সঙ্গে কোটা উঠে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতা কমেনি। বরং এখন তা অনেক ক্ষেত্রেই অতিনির্ভরতায় পরিণত হয়েছে।
২০২৪–২৫ অর্থবছরে এশিয়ান গ্রুপের ১৩টি কারখানার মধ্যে ৭টি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করেছে। সব মিলিয়ে তাদের মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। চট্টগ্রামের বহু উদ্যোক্তার ক্ষেত্রেই একই চিত্র।
এই নির্ভরতাই এখন বড় ঝুঁকিতে ফেলেছে চট্টগ্রামের পোশাক রপ্তানিকারকদের। কারণ, আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করতে যাচ্ছে। এখনও এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি চলছে। তবে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ওপর বেশি শুল্ক বসলে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দেশের মোট রপ্তানির ১৯ শতাংশ এবং পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশ গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি—স্থানীয় গার্মেন্টস কারখানার ৭০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, যেখানে দেশের গড় হার ৪৯ শতাংশ।
চট্টগ্রামে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা তৈরির পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক বাস্তবতা। আশি-নব্বই দশকে যুক্তরাষ্ট্রের কোটাসুবিধা ছিল মূল চালিকাশক্তি। ঢাকার কারখানাগুলো ইউরোপীয় ক্রেতাদেরও আকৃষ্ট করত, কারণ সেখানে যাতায়াত, আবাসন ও ব্যাংকিং সুবিধা ছিল উন্নত। কিন্তু চট্টগ্রামে ছিল অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, যা বিদেশি ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করত।
এ প্রসঙ্গে এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুস সালাম বলেন, “চট্টগ্রামে যোগাযোগব্যবস্থাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় বিদেশি ক্রেতারা আসতেন না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রনির্ভরতা গড়ে ওঠে।”
২০০৫–০৬ অর্থবছরের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কাস্টমস অঞ্চল থেকে পোশাক রপ্তানির ৬৩ শতাংশ গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে সারা দেশের গড় ছিল ৩৩ শতাংশ।
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে বছরে গড়ে ৪০টি নতুন গার্মেন্টস কারখানা স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু ২০০৬–২০১৫ সময়কালে তা কমে দাঁড়ায় বছরে মাত্র ১৭টিতে। ফলে নতুন উদ্যোক্তা কম আসায় পুরোনো উদ্যোক্তারাই এখনকার বাজার ধরে রেখেছেন, যাঁরা মূলত যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর।
ক্লিফটন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী এম ডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারা প্রথম থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করে এসেছেন। হাতে ব্যবসা থাকায় অন্য বাজারের খোঁজ নেওয়া হয়নি।”
এই অতিনির্ভরতাকে ঝুঁকি হিসেবেই দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একক বাজারনির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ। চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাদের এখন বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে।
চট্টগ্রামের গার্মেন্টস শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, যার পেছনে রয়েছে কোটানির্ভর ইতিহাস ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। এখন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক নীতির কারণে সেই নির্ভরতা বড় ঝুঁকিতে রূপ নিচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের উপায় হতে পারে বাজার বৈচিত্র্যকরণ।