যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক চুক্তির আলোচনায় বাংলাদেশ, অনিশ্চয়তা রয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ নিয়ে

প্রতিবেদক: ট্রাম্প প্রশাসনের পারস্পরিক শুল্কহার সংক্রান্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পুরো বিশ্ব এখন অপেক্ষায়। আগামী ৮ জুলাই শেষ হতে যাচ্ছে ট্রাম্প ঘোষিত ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সময়সীমা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এবং কম শুল্ক সুবিধা পেতে ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যই এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছাতে পেরেছে। অথচ ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি তিন মাসের এই সময়ে ৯০টি চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। ভারতের মতো কিছু দেশ চুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকলেও, বিশ্লেষকদের মতে—অতিরিক্ত শর্ত আর জটিলতা এসব চুক্তির বাস্তবায়ন অনিশ্চিত করে তুলছে।

শুল্কবিষয়ক এই অনিশ্চয়তায় যুক্তরাষ্ট্রসহ এশিয়া ও ইউরোপের বহু শিল্পকারখানার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তবে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিছু প্রতিষ্ঠান অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করেও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি পারস্পরিক শুল্কচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আজ ৩ জুলাই (ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় সময় অনুযায়ী) ইউএসটিআরের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল।

বৈঠকের মূল লক্ষ্য হলো—টেক্সটাইল ও অন্যান্য রপ্তানি পণ্যে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত পারস্পরিক শুল্ক হার নিয়ে একটি চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানো। ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করেছে। এই হার পূর্ববর্তী ১৬ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশ পক্ষ থেকে পাল্টা প্রস্তাব এসেছে ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্কের সঙ্গে ১৬ শতাংশ বর্তমান হার যোগ করে সর্বমোট ২৬ শতাংশ হার নির্ধারণের।

বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশীর উদ্দিন এই আলোচনায় অংশ নিতে ওয়াশিংটন গেছেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক চুক্তির তৃতীয় খসড়া নিয়ে সোমবার বাংলাদেশ তাদের মতামত দিয়েছে।

আলোচনার বর্তমান ধীরগতির কারণে ৯০ দিনের বিরতি আরও ৯০ দিন বাড়ানোর সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন আলোচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ী। তিনি জানান, এখনো অনেক দেশ চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যবসায়ী বলেন, বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যেসব শর্ত দিয়েছে, তার বেশিরভাগই জাতীয় স্বার্থ, শুল্ক ও প্যারাশুল্ক সংক্রান্ত—যেগুলো আরও বিশ্লেষণের প্রয়োজন।

দুই দেশই একটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (NDA) সই করায় আলোচনার বিস্তারিত প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আলোচনা ভালো অগ্রগতি দেখাচ্ছে এবং শিগগিরই চূড়ান্ত চুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব।

চুক্তি নিয়ে মূল দ্বন্দ্বের একটি অংশ রয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির ব্যাখ্যায়। বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) অনুসৃত ‘সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’ (MFN) নীতির ভিত্তিতে শুল্কচুক্তি করতে চায়। অর্থাৎ—যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের জন্য তুলা আমদানিতে শুল্ক কমায়, তবে একই সুবিধা অন্যান্য দেশ যেমন চীনকেও দিতে হবে।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বিপাক্ষিক সুবিধা চায় শুধু বাংলাদেশের জন্য, যাতে চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশরা সেই সুবিধা না পায়। ফলে চুক্তি প্রক্রিয়া কিছুটা জটিল হয়ে উঠেছে।

২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০.৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে ৮.৪ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানি হয়েছে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬.২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বশীর উদ্দিন ফোনে বলেন,যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির গন্তব্য, এবং আমাদের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা অনেক। আলোচনায় আমরা এটি গুরুত্ব দিয়েই তুলে ধরছি।”

প্রসঙ্গত, আলোচনার সফল সমাপ্তি না হলে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে, যা রপ্তানিমুখী শিল্পের ওপর চাপ বাড়াবে। তবে সংশ্লিষ্ট মহলের আশা, উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।