যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় উত্তপ্ত ইরান: তেলের দাম ও বিশ্ববাজারে বড় ধাক্কার আশঙ্কা

প্রতিবেদক: ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলা বিশ্ববাজারে তাৎক্ষণিক ও গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে—এমন আশঙ্কায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বাজার খুললেই এর সরাসরি প্রভাব দেখা যাবে বলে বিশ্লেষকেরা পূর্বাভাস দিয়েছেন। বিশেষত তেলের দাম বাড়া এবং নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যমগুলোর (যেমন ডলার, সোনা, বন্ড) দিকে ঝোঁকের প্রবণতা বাড়তে পারে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ নিজেই এ হামলার ঘোষণা দেন। তিনি একে “চমকপ্রদ সামরিক সাফল্য” আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, ইরানের মূল পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ইরান যদি শান্তিচুক্তিতে না আসে, তাহলে আরও হামলার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হলো যে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে, যার প্রতিক্রিয়া আন্তর্জাতিক বাজারে বহুমাত্রিকভাবে পড়বে।

পোটোম্যাক রিভার ক্যাপিটালের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা মার্ক স্পিন্ডেল বলেন, “বাজার শুরুতেই আতঙ্কে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তেলের দাম বাড়বে, তবে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত মাত্রা নির্ধারণে সময় লাগবে।”

ক্রেসেট ক্যাপিটালের প্রধান জ্যাক অ্যাবলিন বলেন, “এটি নতুন ও জটিল একটি ঝুঁকি। জ্বালানি ও মুদ্রানীতিতে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে।

হ্যারিস ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপের ম্যানেজিং পার্টনার জেমি কক্স মনে করেন, প্রথম ধাক্কায় তেলের দাম বাড়লেও তা সাময়িক হতে পারে, যদি ইরান শান্তি আলোচনার পথে আসে।

ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনা শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। শুধু ১০ জুন থেকে ১৩ জুনের মধ্যে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১৮% বেড়ে ৭৯ ডলারে পৌঁছায়—যা প্রায় পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বিশ্বখ্যাত গবেষণা সংস্থা অক্সফোর্ড ইকোনমিকস তিনটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা বলেছে—
সংঘাত প্রশমিত হওয়া ,ইরানের তেল উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হওয়া ,হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যাওয়া .

তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, সবচেয়ে গুরুতর পরিস্থিতিতে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যার ফলে সুদ হার কমার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, পরিস্থিতি যদি আরও ঘোলাটে হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা ডলার ও মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকতে পারেন।

আইবিকেআরের প্রধান বাজার কৌশলবিদ স্টিভ সোসনিক বলেন, “নিরাপদ আশ্রয়লাভের একটি প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এর ফলে ডলার শক্তিশালী হতে পারে, আর বন্ডের সুদহার হ্রাস পেতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “শেয়ারবাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই ধরে নেওয়া যায়, তবে তা কতটা গভীর হবে, তা নির্ভর করবে ইরানের প্রতিক্রিয়া ও তেলের বাজারের গতিপথের ওপর।”

ইতিহাস বলছে, এমন সংঘাতের সময় প্রথম দিকে বাজারে পতন হলেও দীর্ঘমেয়াদে ঘুরে দাঁড়ানোর নজির রয়েছে। যেমন—২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় ।২০১৯ সালে সৌদি তেল স্থাপনায় হামলার সময়।

তথ্য বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজ ও ক্যাপআইকিউ প্রোর মতে, এ ধরনের সংঘাতের তিন সপ্তাহের মধ্যে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক গড়ে ০.৩% কমে, কিন্তু দুই মাসের মধ্যে গড়ে ২.৩% বেড়ে যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলা শুধু একটি সামরিক পদক্ষেপ নয়, এটি একটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সূচনাও বটে। তেলের দাম, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রানীতি ও শেয়ারবাজার—সবখানেই এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। বিশ্বের অর্থনৈতিক ভারসাম্য এখন অনেকটাই নির্ভর করছে ইরানের প্রতিক্রিয়া এবং আলোচনায় ফিরে আসার সম্ভাবনার ওপর।