যুক্তরাষ্ট্রে কেন তৈরি হয় না আইফোন: অ্যাপলের পেছনের কাহিনি

আইফোনের পেছনে ছোট করে লেখা থাকে—“Designed by Apple in California”, আর তার পরের লাইনেই থাকে—“Assembled in China”। শুধু আইফোন নয়, অ্যাপলের প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রেই এই বাক্যদুটি দেখা যায়। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অ্যাপলের একটি প্রিমিয়াম পণ্য ‘ম্যাক প্রো’। তবে সেটিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি—মাত্র এক বছরের মধ্যেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। কেন তা একটু পরে আসছি। তার আগে দেখা যাক, কেন ‘মেড ইন ইউএসএ’ আইফোন দেখা যায় না।

অনেকে মনে করেন, অ্যাপল খরচ কমানোর জন্য চীনে পণ্য তৈরি করে। যদিও এটা আংশিক সত্য, তবে এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর কারণ। আসলে প্রশ্নটা হলো—আইফোন কি আদৌ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা সম্ভব?

অ্যাপলের সিইও টিম কুক একাধিকবার বলেছেন, আইফোন তৈরির জন্য যে পরিমাণ দক্ষ জনবল এবং উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন, তা যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া খুবই কঠিন। চীনে এই ধরনের জনবল এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা অ্যাপলের জন্য অনেক সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করেছে।

গত বছর অ্যাপল বিশ্বব্যাপী ২৩ কোটি আইফোন বিক্রি করেছে, যার ৯০ শতাংশই সংযোজিত হয়েছে চীনে। এছাড়া ভারতসহ কয়েকটি দেশে কিছু পরিমাণ সংযোজন কাজ হয়ে থাকে। এখানে “সংযোজন” শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একটি আইফোন তৈরিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আসে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। অ্যাপলের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০২১ সালে তাদের জন্য যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে এমন ১৪০টি কোম্পানি রয়েছে, যাদের উৎপাদন কেন্দ্র ২৬৮টি স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে।

এই যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই চীনভিত্তিক, যদিও কিছু যুক্তরাষ্ট্রেও আছে। ফক্সকন হলো সবচেয়ে বড় অ্যাসেম্বলি কোম্পানি, যার চীনের ঝেংজুতে প্রায় দুই লাখ কর্মী দিনরাত ২৪ ঘণ্টা আইফোন সংযোজনের কাজ করেন।

অ্যাপলের মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (R&D) এবং সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট। এই সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার কারণে টিম কুককে অনেকেই ‘গুরু’ হিসেবে দেখেন।

সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির লিভি স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক অ্যান্ডি সে বলেন, প্রথমদিকে কোম্পানিগুলো শুধু কম মজুরির জন্য চীনে গিয়েছিল, কিন্তু এখন চীন হয়ে উঠেছে ‘বিশ্বের কারখানা’। এখানে লক্ষ লক্ষ দক্ষ কর্মী, সহস্র যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এবং শক্তিশালী সাপ্লাই চেইনের সমন্বয়ে এক ভিন্নধর্মী ইকোসিস্টেম তৈরি হয়েছে।

টিম কুকের একটি বিখ্যাত মন্তব্য অনুযায়ী, “যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন তৈরির জন্য দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে একটি হলরুমও পূর্ণ করা যাবে না, অথচ চীনে এদের জন্য অনেকগুলো ফুটবল মাঠ প্রয়োজন হবে।”

শুধু তাই নয়, চীনের সাংহাইয়ের মতো শহরেই একটি সম্পূর্ণ ডিভাইস তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের সমন্বিত সাপ্লাই চেইন গড়ে তুলতে বহু বছর সময় এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আইফোন উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপন করলে একটি এক হাজার ডলারের আইফোনের দাম বেড়ে গিয়ে তিন হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এতে অ্যাপলের বিক্রি ও বাজার উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২০১৩ সালে অ্যাপল টেক্সাসে তাদের ‘ম্যাক প্রো’ সংযোজন প্রকল্প চালু করে এবং প্রচারণা চালায়—“Designed in California, Assembled in Texas”। তবে প্রয়োজনীয় স্ক্রু পর্যন্ত সহজে না পাওয়ার কারণে এক বছরেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সাপ্লাই চেইনের সীমাবদ্ধতাই এর প্রধান কারণ ছিল।

চীন নির্ভরতা কমাতে অ্যাপল এখন বিকল্প বাজার খুঁজছে। তারা ভারত ও ভিয়েতনামের মতো দেশে আইফোন উৎপাদন বাড়াচ্ছে। ভারতের বাজার ও সরকারি প্রণোদনা এই উদ্যোগে সহায়ক হয়েছে। ২০২৩ সালে ভারতে ২.২ বিলিয়ন ডলারের আইফোন তৈরি হয়েছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য কিছু আইফোন ভারতেই অ্যাসেম্বল করার পরিকল্পনা রয়েছে।

চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর আইফোনের সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় অ্যাপলের শেয়ারমূল্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৯ শতাংশ পড়ে যায়। দাম বাড়ার আতঙ্কে মার্কিন ক্রেতাদের মধ্যে ‘প্যানিক বায়িং’ শুরু হয়।

সব দিক বিবেচনায় দেখা যায়, চীনে আইফোন তৈরি করা এখনো অ্যাপলের জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও লাভজনক পথ। যদিও অ্যাপল ধীরে ধীরে বিকেন্দ্রীকরণের পথে এগোচ্ছে, তবে টিম কুকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে আইফোন তৈরির মতো কাঠামো এখনো তৈরি হয়নি এবং তা রাতারাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়।