
প্রতিবেদক: দুই দশক আগেও বাংলাদেশের রড তৈরির অন্যতম প্রধান কাঁচামাল হিসেবে পরিচিত ছিল জাহাজভাঙা শিল্প। পুরোনো জাহাজ কেটে পাওয়া লোহার প্লেট ও টুকরা সরবরাহ হতো রড তৈরির কারখানায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। এখন রড তৈরির কাঁচামালের বড় উৎস হয়ে উঠেছে সরাসরি আমদানিকৃত লোহার টুকরা। ফলে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে পড়ছে একসময়ের জাহাজভাঙা-নির্ভর ইস্পাতশিল্প।
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, রড তৈরির জন্য সবচেয়ে ভালো মানের কাঁচামাল পাওয়া যায় পুরোনো জাহাজ থেকেই। কারণ এসব জাহাজের ধাতব উপাদান আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত হয়। কিন্তু পুরোনো জাহাজের আমদানি কমে যাওয়ায় এই উৎকৃষ্ট কাঁচামালের জোগানও কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে শুধু রড উৎপাদনেই নয়; এর সঙ্গে যুক্ত তামা, পিতল, দস্তা, হালকা প্রকৌশল, নৌযান নির্মাণ এবং পুরোনো আসবাব পুনঃব্যবহার খাতেও।
মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম জানান, জাহাজভাঙা শিল্প থেকে শুধু রডের কাঁচামাল নয়, বরং যন্ত্রপাতি, পাইপ, শিট—সবই পাওয়া যায়, যা দেশে হালকা প্রকৌশল ও পুনঃব্যবহারযোগ্য শিল্পে কাজে লাগে। কিন্তু এই উৎস সংকুচিত হলে আমদানি নির্ভরতা বাড়বে এবং খরচও বেড়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
একটি পুরোনো জাহাজ ভেঙে সাধারণত ২০ শতাংশ লোহার টুকরা এবং ৩০ শতাংশ প্লেট পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে গড়ে ৫০ শতাংশ ধাতব উপাদান রড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ২০০৪–০৫ অর্থবছরে যেখানে জাহাজভাঙা শিল্প থেকে রড তৈরির ৮০ শতাংশ কাঁচামাল পাওয়া যেত, ২০২4–২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশে। সেই বছরের ৮ লাখ ৪৫ হাজার টন জাহাজ আমদানির বিপরীতে পাওয়া গেছে ৪ লাখ ২২ হাজার টন কাঁচামাল। আর একই সময়ে আমদানিকৃত লোহার টুকরার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ লাখ ৬৮ হাজার টনে। অর্থাৎ এখন রডের কাঁচামালের ৯৩ শতাংশই আসছে সরাসরি বিদেশ থেকে।
জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন উদ্যোক্তারা। প্রথমত, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং ডলারের দাম বাড়ে। দ্বিতীয়ত, জাহাজভাঙা শিল্পে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন সংকুচিত হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত হংকং কনভেনশনের মানদণ্ড পূরণে পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান জাহাজ আমদানির সুযোগ হারিয়েছে।
বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ডের মহাপরিচালক এ এস এম শফিউল আলম তালুকদার জানান, দেশে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩টি প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিন ইয়ার্ড’ হিসেবে সনদ পেয়েছে। হংকং কনভেনশনের বাস্তবায়ন সময়সীমা ২০২৪ সালের জুনে শেষ হওয়ায় এখন থেকে শুধু সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোই জাহাজ আমদানি করতে পারবে।
বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙা কারখানার পথিকৃৎ হলো পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএসবিআরএ–এর সহসভাপতি মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, সংগঠনে সদস্য সংখ্যা ১১৪ হলেও সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানা মাত্র ১৩টি। এখন সময় এসেছে পরিবেশবান্ধব শিল্পের পথে সব প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে। এজন্য সরকারের নীতিগত সহায়তা দরকার, যাতে নতুন কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে সনদ পেতে পারে। তবেই এই খাতে আবার কর্মচাঞ্চল্য ফিরবে, দেশীয় কাঁচামালের জোগান বাড়বে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও গতি আসবে।