
প্রতিবেদক: রমজানে সাময়িক স্বস্তির পর আবারও চাল, তেল, ডিম, পেঁয়াজ, আটা ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। এর ফলে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের পরিবারগুলোর ওপর আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে। সরবরাহ চেইন বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা মনে করছেন, নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণের অভাব, শীতকালীন সবজির সরবরাহ কমে যাওয়া এবং রমজানে দেওয়া ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ।
এই পরিস্থিতি এমন এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছে, যখন সরকার দেশে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে। মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মিরপুর, দুয়ারীপাড়া, নিউ মার্কেট, মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুলের ক্রেতারা এর প্রমাণ দিয়েছেন।
মিরপুরের বাসিন্দা নকিব হাসান বলেন, “সরকার ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি তুলে নিয়েছে। তারা কি তাহলে এখন আর সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করে না?” মগবাজারের এক ক্রেতা হিমেল সরকার প্রশ্ন তোলেন, “রমজানে যদি সরকার দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে এখন কেন তা করতে পারছে না?”
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও খুচরা বিক্রেতাদের তথ্য অনুযায়ী, মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৫২-৫৮ টাকা, যা আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। সরু চালের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮-৯০ টাকা। খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬২-১৭০ টাকা, যা আগে ছিল ১৫৮-১৬৮ টাকা। পাম অয়েল ১৪৫-১৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আগে যা ছিল ১৪৪-১৫০ টাকা। খোলা আটা এখন ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ছিল ৩৮-৪৫ টাকা। ডিমের দাম প্রতি হালি ৪০-৪৫ টাকা, আগে যা ছিল ৩৮ টাকা।
সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের, যা ৩০-৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকায় পৌঁছেছে। দেশি রসুনের দাম ২০০-২২০ টাকা, আদার দাম ২৫০-৩০০ টাকা এবং ছোট এলাচের দাম ৪,৬০০-৫,১০০ টাকা প্রতি কেজিতে দাঁড়িয়েছে।
টিসিবির তথ্যমতে, খুচরা বাজারে মোটা চালের দাম ১.৯০%, খোলা আটার দাম ২.৪১%, খোলা সয়াবিন তেল ১.৮৪%, পাম অয়েল ২.৩৮%, সুপার পাম অয়েল ১.৬৪%, পেঁয়াজ ৩৮.১৬%, ব্রয়লার মুরগি ২% ও ডিমের দাম ২.৪১% বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক মাসে ১৪টি সবজির মধ্যে সাতটির দাম বেড়েছে।
টমেটোর দাম ২৫-৪০ টাকা, যা ছিল ১৫-২০ টাকা; বেগুনের দাম ৬০-৭০ টাকা, যা ছিল ৫০-৬০ টাকা এবং লাউ বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৬০ টাকায়, যা ছিল ৩৫-৪০ টাকা। কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আওরঙ্গজেব লাবলু জানান, শীতের সবজির মৌসুম শেষ হওয়ায় গ্রীষ্মকালীন সবজির সরবরাহে প্রভাব পড়েছে, ফলে দাম বেড়েছে।
সরকার ভ্যাট অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৪ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম ১২ টাকা বেড়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন জানিয়েছেন, সরকারের অগ্রাধিকার এখন রাজস্ব আদায়।
তেজগাঁওয়ের ডিম ব্যবসায়ী আমানত উল্লাহ জানান, ঈদের পর অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে যাওয়ায় ডিমের চাহিদা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য সরকার রাজস্ব বৃদ্ধি ও ভর্তুকি হ্রাসে মনোযোগী হয়েছে। সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “পরবর্তী আইএমএফ ঋণের জন্য যোগ্য হতে হলে, সরকারকে অবশ্যই রাজস্ব বৃদ্ধি করতে হবে।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রমজানে প্রচুর শীতকালীন সবজি থাকায় দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন তা নেই। সেইসঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণে নীতিগত পদক্ষেপের অভাবও আছে। তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক চাঁদাবাজিও মূল্যবৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, সরকার জনকল্যাণের চেয়ে ব্যবসায়ী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তিনি বলেন, “সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই আমদানি পর্যায়ে আগাম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে।” তিনি সরকারের কাছে নিত্যপণ্যের ওপর কর পর্যালোচনার দাবি জানান এবং যারা বাজার অস্থিতিশীল করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।