
প্রতিবেদক: রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি বাজারে পানপাতা বাছাই করছিলেন কৃষক এনামুল হক। উপজেলার বাকশিমইল ইউনিয়নের খাড়ইল গ্রামের এই কৃষক দুই বিঘা জমিতে পান চাষ করেছেন। কিন্তু বাজারে প্রতি বিড়া (৬৪টি পাতা) পান মাত্র ৪ টাকা দরে বিক্রি করেও শ্রমিকের খরচ উঠছে না বলে তিনি জানান।
এনামুল বলেন, “একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ তিন পোয়া (৯৬ বিড়া) পান তুলতে পারেন। সেগুলো সংগ্রহ ও বাজারে আনতে খরচ হয় প্রায় ৬০০ টাকা। অথচ ওই পান বিক্রি করে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০০ টাকা। পানে এখন শুধু লস আর লস।”
রাজশাহীতে পান সাধারণত বিড়া ও পোয়া—এই দুইভাবে বিক্রি হয়। ৩২ বিড়া সমান ১ পোয়া। এনামুলের পানের গাছ থেকে যেসব পাতা উঠেছে, সেগুলো আকারে ছোট। মৌগাছি বাজারে বড় আকারের পানের প্রতি বিড়া এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা দরে, যেখানে মাত্র ১৫ দিন আগেও বড় পানের প্রতি বিড়া ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো।
মোহনপুর উপজেলার মদনহাটি গ্রামের কৃষক আলতাব হোসেন জানান, “বুধবার ১০ থেকে ১২ টাকা দরে বিক্রি করেছি, কিন্তু বৃহস্পতিবার কেউ দামই করেনি। ঈদের আগে খরায় চিনিপোকা ধরেছিল। বৃষ্টিতে সেটা চলে গেলেও এখন গাছে পাতা বেশি, কিন্তু দাম নেই।”
পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের শুভিপাড়া গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান জানান, এবার ফলন ভালো হলেও প্রতি বিড়া পান ১০–১৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। এমন দাম থাকলে চাষে খরচও উঠবে না বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
মৌগাছি বাজারে ৩০ বছর ধরে পানের ব্যবসা করছেন মো. আয়েজ উদ্দিন। তিনি জানান, বাজারের সবচেয়ে ভালো মানের পানও এখন ৩০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যেখানে ১৫ দিন আগেও ছিল ১০০ টাকা।
আরেক ব্যবসায়ী মো. ইসমাঈল ব্যাপারী বলেন, “বুধবার যে পান ১৪ টাকায় বিড়া কিনেছিলাম, সেটা বৃহস্পতিবার হয়েছে ৫ টাকা, তাও বিক্রি হয়নি। ঢাকায় পাঠানো পানের চাহিদাও নেই।”
পানের দাম কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ভরা মৌসুম, ফলে সরবরাহ বেশি। পাশাপাশি পান সাধারণত নিম্নআয়ের মানুষ খায়, আর বর্তমানে সুপারির দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা পান খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে। গত পাঁচ থেকে সাত বছরে এত কম দাম আর দেখা যায়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে জেলায় ৪ হাজার ৫০৯ হেক্টর জমিতে পান আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৬৮১ মেট্রিক টন। গত বছর উৎপাদন হয়েছিল ৭৭ হাজার ২২০ মেট্রিক টন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট ‘রাজশাহীর মিষ্টি পান’ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত হয়। প্রতিবছর রাজশাহীতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার পান কেনাবেচা হয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই সময়কালে পান বেশি উৎপাদিত হয়, তাই দাম পড়ে যায়। এ বছর অতিবৃষ্টি ও ভোক্তার ব্যয় বৃদ্ধি দাম কমে যাওয়ার বড় কারণ। তবে মার্চ থেকে মে মাসে পান সর্বোচ্চ ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়, আর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারিতে গড়ে ১০০ টাকা। তাই পুরো মৌসুম বিবেচনায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলা যাবে না।