
প্রতিবেদক: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদ পরিশোধে জটিলতার অবসান হচ্ছে না। রাশিয়ার ব্যাংকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকা সুইফট সিস্টেমের নিষেধাজ্ঞার কারণে সরাসরি অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু বিকল্প উদ্যোগ নেওয়া হলেও, শেষ পর্যন্ত সেগুলো কার্যকর হয়নি।
সর্বশেষ সোনালী ব্যাংকে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট কোম্পানির বৈদেশিক মুদ্রা (এফসি) হিসাবের মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়, তবে সোনালী ব্যাংক রাজি হয়নি। ব্যাংক জানিয়েছে, রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানের হিসাবে অর্থ পরিশোধের ফলে বিদেশি করেসপন্ডিং ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ঝুঁকি সৃষ্টি হবে, যা দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঋণ চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ১ দশমিক ২৬৫ বিলিয়ন ডলার অগ্রিম পরিশোধ করার কথা ছিল, বাকি ৯০ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেয়া হয় রাশিয়া সরকার থেকে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে পরিশোধে জটিলতা সৃষ্টি হয়।
সুইফট নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে বাংলাদেশের পক্ষে ঋণ পরিশোধে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসক্রো অ্যাকাউন্টে প্রায় ৮০৯ মিলিয়ন ডলার জমা রয়েছে, তবে রাশিয়া এই অর্থ নিজেদের জিম্মায় নিতে চাইছে।
গত কয়েক মাসে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশে এসে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছেন এবং বাংলাদেশে রাশিয়ার ব্যাংক শাখা খোলার অনুমতি চেয়েছেন। তবে পরিস্থিতির কারণে এটি সম্ভব হয়নি। এছাড়া, রাশিয়া বিকল্প পদ্ধতিতে বকেয়া পরিশোধের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। ডিসেম্বরে উভয় দেশের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়, কিন্তু ব্যাংক অব চায়না জানিয়ে দেয়, এ ধরনের হিসাবের মাধ্যমে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ করা যাবে না।
এদিকে, রাশিয়া সোনালী ব্যাংককে এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট কোম্পানির এফসি হিসাবে পরিশোধের প্রস্তাব দেয়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায় যে, এই ধরনের লেনদেন সুইফট নিষেধাজ্ঞার কারণে নিরাপদ নয়। শেষ পর্যন্ত, রাশিয়ার চাহিদা অনুযায়ী সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তবে এটি একটি সংকটজনক পরিস্থিতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।Top of Form
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে নতুন একটি জটিলতা দেখা দিয়েছে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের এসক্রো অ্যাকাউন্টে জমা থাকা ডলার থেকে সুদ পরিশোধের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার সোনালী ব্যাংকে এফসি হিসাব হিসেবে স্থানান্তর করা হয়। একই সঙ্গে সোনালী ব্যাংককে পরিশোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী সম্প্রতি ইআরডিকে এক চিঠিতে জানান, স্থানীয় কিছু সাব-কন্ট্রাক্টর প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হলেও, বিদেশি সাব-কন্ট্রাক্টরকে ২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধের জন্য সোনালী ব্যাংক তাদের বিদেশি করেসপন্ডেন্ট তিনটি ব্যাংকের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছিল। তবে তারা আসন্ন ঝুঁকি বিবেচনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট লেনদেন তাদের মাধ্যমে করতে অস্বীকৃতি জানায়।
সোনালী ব্যাংক আরও জানিয়েছে যে, সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ক্রস-বর্ডার লেনদেন ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া, বৈদেশিক লেনদেনটি কার্যকর হলে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে অন্যান্য করেসপন্ডিং ব্যাংকের সম্পর্ক বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যা দেশের সার্বিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এমন পরিস্থিতিতে, বকেয়া পরিশোধের বিকল্প উপায় খুঁজতে ১১ মার্চ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৈঠকে কোনো যৌক্তিক সমাধান পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান সমকালকে জানান, ঝুঁকি ও ঝামেলামুক্ত উপায় খোঁজার চেষ্টা চলছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, এ জটিলতা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো কারণে হয়নি। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই এর দায় রাশিয়ার দিকে থাকা উচিত। বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে, এ বকেয়া পরিশোধ করতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য যেন না হয়।”
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৭ সালে রাশিয়া থেকে ঋণ আসা শুরু হয় এবং ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে ঋণের মূল কিস্তি (আসল পরিশোধ) শুরু হওয়ার কথা। প্রতিবছর ছয় মাস পরপর দুই কিস্তিতে মোট ৩৮ কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে, যার সঙ্গে ১১ কোটি ডলার সুদ যোগ হবে। তবে সময়ের সাথে সাথে সুদ ও আসলের পরিমাণ কমে বা বাড়তে পারে।