লবণ ছাড়া চামড়া, লবণযুক্ত দাম—দ্বৈত ব্যবস্থার ফাঁদে মৌসুমি ব্যবসায়ী

প্রতিবেদক: প্রতিবছর কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে একই ধরনের সমস্যা দেখা যায়। সাধারণ কোরবানিদাতা এবং মৌসুমি ছোট ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন যে তারা চামড়ার ন্যায্য দাম পাননি। অনেক জায়গা থেকে এমন খবরও আসে যে চামড়া ফেলে দেওয়া বা মাটিতে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও চামড়া পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, তারা সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কিনেছেন। সরকারও বলে থাকে, এবার সবচেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। যারা অভিযোগ করেন তারা সঠিক সময়ে আড়তে চামড়া না এনে নষ্ট করে ফেলেছেন। এই দুই পক্ষের বক্তব্যের মধ্যে একটি ‘লবণরেখা’ আছে, অর্থাৎ লবণবিহীন চামড়া বনাম লবণযুক্ত চামড়া।

সরকার এবং বড় ব্যবসায়ীরা মূলত লবণ দেওয়া চামড়ার বাজারকে গুরুত্ব দেন। তারা প্রতিবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। স্থানীয় মাঝারি ব্যবসায়ীরা লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। সারাদেশে এ ধরনের ব্যবসায়ী ও ট্যানারি মালিক প্রায় এক লাখের মতো আছেন। তবে সাধারণ কোরবানিদাতা থেকে শুরু করে মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার সংগৃহীত চামড়া এই ব্যবস্থার বাইরে পড়ে। এইসব জায়গা থেকে লবণবিহীন চামড়া ক্রয়-বিক্রয় হয়, যেখানে দাম কম এবং সংরক্ষণ কঠিন হওয়ায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণেই সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে ভুক্তভোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।

এবারের চামড়া বিক্রির চিত্র ঢাকায় গরুর কাঁচা চামড়া ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে, যেখানে ঢাকার বাইরের গ্রামে দাম ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। ছাগলের চামড়ার ক্রেতাও কম ছিল। বিভিন্ন এতিমখানা এবং মাদ্রাসায় চামড়া সংগ্রহ হলেও অনেক জায়গায় চামড়া নষ্ট হয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যেমন চট্টগ্রামে ১০ টনের মতো চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়েছে। সরকার গতবারের তুলনায় ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করেছে, যেখানে ঢাকার বাইরে দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।

বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, গত ১২ বছরে এবার সবচেয়ে বেশি দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে। তবে যারা সময়মতো চামড়া আড়তে নিয়ে যায়নি, তাদের জন্য ক্ষতি হয়েছে। আগে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া কিনতেন, কিন্তু এখন তারা লাভ না হওয়ায় কমে গেছেন। কারণ সরকার শুধু লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে, লবণবিহীন চামড়ার দাম তারা ঠিক করেনা। এ কারণে প্রাথমিক ক্রেতারা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রেই চামড়া মসজিদ, মাদ্রাসা বা এতিমখানায় দান করা হয়, যাদের কম দামেই বিক্রি করতে হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চামড়ার বাজারে আন্তর্জাতিক মানের ‘লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) সনদ আনা জরুরি। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে দাম নির্ধারণের বিরোধিতা করেন এবং মুক্তবাজারে দাম নির্ধারণ হওয়াই সেরা বলে মনে করেন। এছাড়াও ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য শোধনাগার বাস্তবায়ন এবং কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীদের ঋণ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন, যা চামড়ার দাম বাড়াতে সাহায্য করবে।

সরকারও ভবিষ্যতে চামড়ার দাম নির্ধারণ না করার পক্ষে রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বিনামূল্যে লবণ বিতরণ করে চামড়া সংরক্ষণে সাহায্য করা হচ্ছে, যাতে চামড়া ভালো দামে বিক্রি হতে পারে। পাশাপাশি সাভারে ট্যানারি পল্লির কাছে শেড নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে, যা চামড়া সংরক্ষণ সহজ করবে এবং বাজার মূল্য বাড়াবে।