শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংক একীভূত হয়ে গড়ছে নতুন ইসলামি ব্যাংক, মূলধন দেবে সরকার

প্রতিবেদক: আর্থিক সংকটে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে একটি বড় ইসলামি ধারার নতুন ব্যাংক গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শুরুতে এই ব্যাংকে মূলধন দেবে বাংলাদেশ সরকার এবং মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা খাতে (এসএমই) অর্থায়নের জন্যই এর কার্যক্রম পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই নতুন ব্যাংকের অনুমোদন (লাইসেন্স) দেবে এবং পুরোনো পাঁচ ব্যাংকের আমানত ও সম্পদ এই ব্যাংকের অধীনে স্থানান্তর করা হবে। এই প্রক্রিয়া ঈদের ছুটির পর শুরু হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বুধবার এই পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) ডেকে এই পরিকল্পনার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। ব্যাংক একীভূত হলেও গ্রাহকদের লেনদেনে কোনো সমস্যা হবে না। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকের গ্রাহক হয়ে যাবেন। শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য ব্যাংকাররা আপাতত বহাল থাকবেন। প্রক্রিয়াটি শেষ হতে প্রায় তিন বছর সময় লাগতে পারে।

একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এক্সিম ব্যাংক গত ৯ এপ্রিল গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা দিয়েছিলেন যে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো একীভূত করে বড় দুটি ব্যাংক গঠন করা হবে।

এদের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন। অন্য চারটি ব্যাংক পরিচালনা করে শেখ হাসিনা–ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ। গত সরকার আমলে এই ব্যাংকগুলোর মালিকরা বিপুল অর্থ তুলে নেওয়ায় ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেয়। এক্সিম বাদে বাকি চারটিতে নিয়োগ দেওয়া হয় স্বতন্ত্র পরিচালক।

ঈদের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনায় যুক্ত হবে। প্রত্যেক ব্যাংকের সঙ্গে একটি পৃথক কমিটি গঠন করা হবে। ইতিমধ্যে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান এসব ব্যাংকের সম্পদের মান নিরীক্ষা করেছে। কারও কোনো আপত্তি থাকলে তা জানাতে বলা হয়েছে। কেউ যদি নিজেকে আর্থিকভাবে সবল প্রমাণ করতে পারে, তবে তাকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। না হলে ২০২৫ সালের ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আওতায় একীভূতকরণের কাজ শুরু হবে এবং আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে এটি শেষ হবে।

একীভূতকরণের আওতায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির (AMC) কাছে হস্তান্তর করা হবে যাতে নতুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে থাকে। এর ফলে বিদেশি লেনদেনে খরচ কমবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থেকেও সুবিধা মিলবে।

নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হবে এবং এতে সরকার ও বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীরা মূলধন জোগাবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এরপর পুরোনো পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায় নতুন ব্যাংকের কাছে হস্তান্তর করা হবে এবং ধীরে ধীরে শাখাগুলো একীভূত করা হবে। জনবলও কমানো হবে। নতুন ব্যাংক পুরোমাত্রায় কার্যক্রম শুরু করার পর বেসরকারি খাতে শেয়ার ছাড়া হবে এবং উদ্যোক্তারা পরিচালনায় যুক্ত হতে পারবেন।

গতকালের সভায় গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও ডেপুটি গভর্নর কবির আহম্মদ পাঁচ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের বিষয়টি বিস্তারিত অবহিত করেন। এ সময় এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক নিজেদের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতির কথা জানান।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন জানান, নতুন ব্যাংক গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সবাইকে অবহিত করেছে। কেউ যদি সবল প্রমাণ করতে পারে, তাহলে তাকে একীভূত প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হবে। তবে সবাই বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ ব্যাংকের রয়েছে ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮ উপশাখা, ৫০০ এজেন্ট ও ১ হাজার এটিএম বুথ। এসব ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন ১৫ হাজারের বেশি কর্মকর্তা–কর্মচারী। গ্রাহকের হিসাব রয়েছে ৯২ লাখ, মোট আমানত ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা আমানতের চেয়ে অনেক বেশি। এই ঘাটতি পূরণে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯০ শতাংশ ঋণ এস আলম গ্রুপের কাছে, যা অধিকাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৭০ শতাংশ এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ২০ শতাংশ ঋণও এস আলম-সংশ্লিষ্ট। এক্সিম ব্যাংকের ১০ শতাংশ ঋণ সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। এসব ঋণ আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, বড় আকারে একটি ইসলামি ব্যাংক গঠনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা ইসলামি ব্যাংকিং খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী মনে করেন, কেবল একীভূত করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। ব্যাংক যদি রাজনৈতিক লুটপাটের লক্ষ্য হয় এবং আর্থিক খাতে সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করা হয়, তবে তা কোনো কাজেই আসবে না। তিনি প্রশ্ন তোলেন—গত ৯ মাসে সুশাসন ফিরল না কেন, ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারল না কেন? তাঁর মতে, পরিচালনার মান ও সুশাসনই নির্ধারণ করবে নতুন ব্যাংকের ভবিষ্যৎ।