শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমছে, অগ্রাধিকার পাচ্ছে অবকাঠামো

প্রতিবেদক: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খসড়া অনুযায়ী, এ দুই খাতে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ৬ মে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় নতুন এডিপির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামীকাল রোববার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় এটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ হ্রাসের প্রস্তাব এসেছে। খসড়া এডিপি অনুসারে, শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের বরাদ্দ ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকার চেয়ে ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা কম। স্বাস্থ্য খাতের ৩৫টি প্রকল্পে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, যেখানে চলতি বছরে বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা—অর্থাৎ কমছে আড়াই হাজার কোটি টাকা।

বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের এ অবস্থা উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের মতে, অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ প্রয়োজন হলেও বর্তমানে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই ব্যক্তিকে নিজে বহন করতে হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, বরাদ্দ কমার বিষয়টি নীতিগতভাবে হতাশাজনক। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার ও বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, যাঁরা এত দিন ধরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলে এসেছেন, তাঁরাই যদি এখন বরাদ্দ কমান, তা হবে বিস্ময়কর। তবে তিনি একে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণ কমে যাওয়া এবং খরচের সক্ষমতার অভাবের ফলাফল বলেও উল্লেখ করেন।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বরাদ্দ হ্রাসের পেছনে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। তাদের ভাষায়, প্রকল্পের অর্থ খরচের সক্ষমতা যেহেতু যথাযথ নয়, তাই বরাদ্দও সেই অনুযায়ী কমানো হয়েছে। অর্থাৎ, যাতে অর্থ বরাদ্দের পর তা কার্যকরভাবে খরচ করা যায়।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির আকারও কমছে। নতুন এডিপির আকার নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বছরের ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার তুলনায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা স্থানীয় উৎস থেকে এবং ৮৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সহায়তা থেকে আসবে। এবারের এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা ১ হাজার ১৪২টি।

নতুন খসড়া এডিপিতে অগ্রাধিকার পাওয়া খাতগুলোর মধ্যে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত শীর্ষে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এরপর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ৩২ হাজার ৩৯২ কোটি এবং শিক্ষা খাতে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। এছাড়া গৃহায়ণে বরাদ্দ ২২ হাজার ৭৭৬ কোটি, স্বাস্থ্যে ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ১৬ হাজার ৪৭২ কোটি, কৃষিতে ১০ হাজার ৭৯৫ কোটি, পরিবেশ ও পানিসম্পদে ১০ হাজার ৬৪১ কোটি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবায় ৫ হাজার ৩৮ কোটি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ৩ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রায় সব খাতেই গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ কমেছে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত—যা সরাসরি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত—সেই খাতগুলো যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাজেটে মৌলিক সেবা খাতে এই ধরনের উপেক্ষা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি নেতিবাচক বার্তা বহন করে। এখন সময় এই দুটি খাতে বিনিয়োগ ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার পুনঃনির্ধারণ করার।