সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে

অনলাইন ডেক্স: রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা আবারও পরিবর্তন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ পরিচালকদের অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনতে নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে।

২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে এক সপ্তাহের মধ্যেই, ১৬ এপ্রিল, বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়। দীর্ঘদিন বিষয়টি অনিষ্পন্ন থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।

গত ৬ জানুয়ারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের সভাপতিত্বে ঢাকায় সচিবালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ ও বিশ্বব্যাংকের সমন্বয়ে মার্চ মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত খসড়া নীতিমালা প্রস্তুত করবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এরপর জুনের মধ্যে তা অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির কাছে পাঠানো হবে।

এ বিষয়ে সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, “আমরা নীতিমালা সংশোধনের কাজ করছি। পরিচালকদের অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেই চূড়ান্ত করা হবে।

নতুন নীতিমালার খসড়া অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ব্যক্তিরা ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য হতে পারবেন না—

  • ঋণখেলাপি বা করখেলাপি ব্যক্তি।
  • ১০ বছরের প্রশাসনিক, ব্যবস্থাপনা বা পেশাগত অভিজ্ঞতা না থাকা ব্যক্তি।
  • ফৌজদারি অপরাধ, জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি ।
  • দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের বিরূপ পর্যবেক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তি ।
  • আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘনের কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ।
  • একইসঙ্গে একাধিক ব্যাংকের পরিচালক থাকা ব্যক্তি ।

বিশ্বব্যাংক মনে করে, ব্যাংক খাত থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে, তার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব এবং ব্যাংকারদের অসততা দায়ী। তবে চূড়ান্ত দায় পরিচালনা পর্ষদের, কারণ তারা ঋণ অনুমোদন করেন। এখন পর্যন্ত পরিচালকদের বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুবই বিরল। এ কারণেই বিশ্বব্যাংক জবাবদিহি বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে।

একশ্রেণির লুটেরা গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশে ব্যাংকের ঋণপ্রস্তাব তৈরি হয়। ব্যাংকের কর্মকর্তা পর্যায়ক্রমে প্রস্তাব পাস করেন এবং চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় পরিচালনা পর্ষদ। উদাহরণ হিসেবে বেক্সিমকো গ্রুপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আওতায় থাকা ৩১টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকঋণ ২৮,৬০৭ কোটি টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে মাত্র ১৭.২৪ শতাংশ অর্থাৎ ৪,৯৩২ কোটি টাকার সম্পদ বন্ধক রাখা হয়েছে। জনতা ব্যাংক এত বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করেছে, যা পর্ষদ সদস্যদের জবাবদিহি থাকলে সম্ভব হতো না।

পরিচালকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নতুন নীতিমালার প্রণয়ন জরুরি। সংশোধিত নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এবং দুর্নীতি কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য শক্ত কোনো পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা দীর্ঘদিন ছিল না। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে সরকার ২০০৯ সাল থেকে ইচ্ছেমতো পরিচালক নিয়োগ দিয়ে আসছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক আমলা, সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী এমনকি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতাদেরও বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদে বসানো হয়। কিন্তু এসব পরিচালকের অনেকেরই অর্থনীতি, ব্যাংকিং, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ছিল না বলে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

প্রথম মেয়াদে দলীয় নিয়োগের ব্যাপক সমালোচনার পরও আওয়ামী লীগ সরকার ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে এসে একই ধারা অব্যাহত রাখে। এর ফলে বেসিক ব্যাংক, হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি কেলেঙ্কারি ঘটে। পরবর্তী সময়ে এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যাংক লুটপাটের মতো আরও বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসে।

তবে দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দলীয় নিয়োগ থেকে কিছুটা সরে আসেন এবং একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেন। ২০১৪ সাল থেকে ব্যাংকগুলোর পর্ষদকে নিয়োগের জন্য প্রস্তাব পাঠানোর নিয়ম চালু হয়। কিন্তু তাতেও মূলত দলীয় আনুগত্যসম্পন্ন সাবেক আমলা ও শিক্ষকদেরই নিয়োগ দেওয়া হতো।

ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আনতে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নতুন পরিচালক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকার অংশীদারিত্বে থাকা বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগের জন্য সুস্পষ্ট যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। এই নীতিমালা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।

নীতিমালা অনুযায়ী, পরিচালনা পর্ষদে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি, ব্যবসা ও বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, আইন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়। এছাড়া—

  • ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব ও নিরীক্ষা বোঝার জন্য একজন সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক (সিএ)
  • আইনি বিষয় বোঝার জন্য একজন সাবেক জেলা জজ বা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
  • একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকার নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়

এছাড়া, পর্ষদে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও বাস্তবে তা মানা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, সোনালী ব্যাংকে ২ জন নারী সদস্য থাকলেও অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক এবং বিডিবিএলে কোনো নারী সদস্য নেই।

নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও সমালোচনা

যদিও ২০২২ সালের নীতিমালা পরিচালক নিয়োগে কিছু শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছে, বাস্তবে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। এখনো অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ ব্যক্তিদের পর্ষদে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে “সরকারের বিবেচনায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ” ব্যক্তিদের নিয়োগের শর্তটি অস্পষ্ট হওয়ায় দলীয় আনুগত্য সম্পন্ন ব্যক্তিরা নিয়োগ পাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক মাইন উদ্দিন মনে করেন, পরিচালক পদে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রথমে তাঁদের সম্মানী বাড়াতে হবে। এরপর কঠোর জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবে আমানতের টাকা যাচাই-বাছাই ছাড়া বিতরণ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া, নারী সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ কোটা রাখার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “যদি শুধু কোটা পূরণের জন্য অনুপযুক্ত নারী সদস্য নিয়োগ করা হয়, তবে তা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।”

দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা থাকা জরুরি, তবে তার বাস্তবায়ন আরও গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ নিশ্চিত করা না গেলে ব্যাংক খাতে দুর্নীতি ও লুটপাট অব্যাহত থাকবে। বর্তমান নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই কেবল ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব।