
প্রতিবেদক: একসময় গোপনীয়তার জন্য বিখ্যাত সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো ছিল সারা বিশ্বের কালো টাকার গন্তব্য। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অর্থের হিসাব নিয়মিতই প্রকাশ পাচ্ছে। তারপরও কেন ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশের নাগরিকরা এসব ব্যাংকে অর্থ রাখছেন, তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠেছে।
ইকোনমিক টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এসব অর্থের বড় অংশই এখন আর ‘কালো টাকা’ নয়। বরং, অনেক অনাবাসী ভারতীয় ও ধনী পরিবার বিদেশে থাকা সম্পদ পুনর্বিন্যাস করে সুইজারল্যান্ডে স্থানান্তর করছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউরোপে বসবাসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবেও অনেকে সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছেন। সুইজারল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর এই মুহূর্তে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে কারণ তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা অন্য অনেক দেশের তুলনায় সহজ ও স্থিতিশীল।
বিশেষ করে সুইজারল্যান্ডে ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অর্থ রাখা সহজ। এসব ব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানা গোপন রাখা যায় এবং উত্তরাধিকার সংক্রান্ত পরিকল্পনায়ও সুবিধা পাওয়া যায়।
২০২৪ সালে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ভারতীয়দের অর্থ ৩ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯২ কোটি ডলার। তবে এর বড় অংশ বিমা কোম্পানি, সম্পদ ব্যবস্থাপক ও অন্যান্য আর্থিক মাধ্যমে রাখা। ব্যক্তিগত হিসাবের বৃদ্ধি মাত্র ১১ শতাংশ।
আইন বিশেষজ্ঞ মইন লাধা বলছেন, “সুইস ব্যাংকে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধি মূলত বিশ্বব্যাপী করনীতির পরিবর্তন ও নিরাপদ আর্থিক গন্তব্য খোঁজার ফল।” যুক্তরাজ্যের ২০০ বছরের পুরোনো করব্যবস্থায় সাম্প্রতিক পরিবর্তনের পর বহু ভারতীয় পরিবার বিদেশে দ্বিতীয় আবাস খুঁজছেন কর ফাঁকি এড়াতে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঈশা শেখরি বলেন, সুইস ব্যাংকের মুদ্রা শক্তিশালী এবং গোপনীয়তা এখনও তুলনামূলকভাবে বেশি। তাই ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও এই দেশ অনেকের কাছে বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয়। যদিও বর্তমানে অধিকাংশ দেশের সঙ্গে ব্যাংক তথ্য বিনিময় চুক্তি রয়েছে, তারপরও ট্রাস্ট ও বিনিয়োগ মাধ্যম ব্যবহার করে কিছুটা গোপনীয়তা বজায় রাখা সম্ভব।
এদিকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ সুইস ব্যাংকগুলোতে এক বছরের ব্যবধানে ৩৩ গুণ বেড়েছে।
২০২৩ সালে যেখানে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ, সেখানে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯ কোটি সুইস ফ্রাঁ (প্রায় ৬৬ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার)।
এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দেশীয় অনিশ্চয়তা, বিদেশে অর্থ সংরক্ষণের আগ্রহ, এবং বিনিয়োগের বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজে থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে এই অর্থপ্রবাহ বেড়েছে।
বর্তমানে সুইজারল্যান্ড বহু দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক তথ্য বিনিময় চুক্তি করেছে, ফলে আগের মতো করে গোপনে টাকা রাখা কঠিন। তারপরও সুইস ব্যাংকগুলোতে কিছু মাত্রার গোপনীয়তা এবং আইনি সুযোগ এখনো বিদ্যমান। বিশেষ করে যেসব হিসাব সরাসরি ব্যক্তির নামে না থেকে ট্রাস্ট বা কোম্পানির মাধ্যমে খোলা, সেগুলোর মালিকানা শনাক্ত করা কঠিন।
বিশ্বব্যাপী আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও তথ্য আদান-প্রদানের প্রবণতা বাড়লেও, সুইস ব্যাংকগুলো এখনো অনেকের জন্য একটি ‘নিরাপদ আশ্রয়’। করনীতি, উত্তরাধিকার পরিকল্পনা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আর্থিক ব্যবস্থার গোপনীয়তা—এসব মিলিয়েই ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশের বহু নাগরিক এখনো সুইস ব্যাংককেই বেছে নিচ্ছেন।