সুশাসনে শীর্ষে ব্র্যাক ব্যাংক, সংকটে বিতর্কিত ব্যাংকগুলো

প্রতিবেদক: ২০২৪ সালে দেশের ব্যাংক খাতে মিশ্র চিত্র পরিলক্ষিত হয়েছে। কিছু ব্যাংক উল্লেখযোগ্য পরিমাণে নিট বা প্রকৃত মুনাফা করতে সক্ষম হলেও, অনেক ব্যাংকের মুনাফা কমেছে এবং কিছু ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যেসব ব্যাংকে বড় ধরনের লুটপাট ও অনিয়ম হয়েছে, তাদের অনেকগুলোরই আর্থিক অবস্থা এখন নাজুক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জন্য এখন পর্যন্ত ২২টি ব্যাংকের মুনাফার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৩টি ব্যাংকের নিট মুনাফা বেড়েছে, সাতটি ব্যাংকের মুনাফা কমেছে এবং দুটি ব্যাংকের লোকসান বেড়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক মুনাফায় সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি দেখিয়েছে। বিপরীতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক বড় ধরনের মুনাফা পতনের মুখে পড়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের লোকসান বেড়ে গেছে।

নিট মুনাফা হিসাব করা হয় পরিচালন মুনাফা থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ও করপোরেট কর পরিশোধের পর। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকের করহার ৩৭.৫ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ। এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি জোরদার করায় ব্যাংকগুলোকে আরও বেশি নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়েছে। তারা ঋণ প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন করে কী পরিমাণ ঋণ খেলাপি হিসেবে গণ্য হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ে এবং অধিক নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখায় অনেক ব্যাংকের মুনাফায় চাপ পড়ে।

ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন জানান, পরিচালন মুনাফা ভালো হলেও ভবিষ্যতের ঝুঁকি মাথায় রেখে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, কিছু ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ভালো আয় করেছে। সুনামধন্য ব্যাংকগুলো বিপুল পরিমাণ আমানত পেয়েছে, যা তাদের মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করেছে।

ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফা ২০২৩ সালের ৮২৮ কোটি টাকা থেকে ২০২৪ সালে বেড়ে ১,৪৩২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটির এমডি সেলিম আর এফ হোসেন জানান, সুশাসন ও নিয়মানুবর্তিতার কারণে আমানতকারীরা আস্থা রেখে ব্র্যাক ব্যাংককে বেছে নিয়েছে এবং লাভজনক খাতে বিনিয়োগের কারণে রেকর্ড মুনাফা এসেছে। সিটি ব্যাংকও একই ধরনের সাফল্য পেয়েছে। তাদের মুনাফা ২০২৩ সালের ৬৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ১,০১৪ কোটি টাকায় পৌঁছায়।

পূবালী ব্যাংকের মুনাফা বেড়ে ৭৮০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের ৭৫০ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ৭৪৫ কোটি এবং বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের মুনাফা ৬৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সিটিজেন ব্যাংক ২০২৩ সালে দেড় কোটি টাকা লোকসান করলেও ২০২৪ সালে ৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।

অন্যদিকে, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মুনাফা ৮০২ কোটি টাকা থেকে কমে ৪৭৩ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ৩৫৮ কোটি থেকে নেমে ১৬৯ কোটি টাকায় এসেছে। ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা কমেছে ৪২৭ কোটি থেকে ৩৭৩ কোটিতে এবং মেঘনা ব্যাংকের ৬৮ কোটি থেকে ৪৬ কোটিতে। এই ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের সমস্যা না থাকলেও নিরাপত্তা সঞ্চিতির বোঝা বাড়ায় মুনাফা হ্রাস পেয়েছে।

শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ জানান, ব্যাংকটি অতিরিক্ত ৪৩০ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করেছে। ভবিষ্যতের ব্যবসা-বাণিজ্য অস্থিরতা ও মন্দা পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন প্রস্তুতি রাখা হয়েছে, যার প্রভাবে মুনাফা কমেছে।

ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান ২০২৩ সালের ১,৪৯৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ১,৭০৬ কোটি টাকায় এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের লোকসান ৫৬ কোটি থেকে বেড়ে ৯৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এদিকে বেসরকারি খাতের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ফলে এসব ব্যাংক মুনাফা বা লোকসান নির্ধারণ করতে পারছে না এবং লভ্যাংশ ঘোষণা দিতেও বিলম্ব হচ্ছে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এবার আর্থিক প্রতিবেদনগুলো বাস্তব ভিত্তিক এবং স্বচ্ছভাবে তৈরি করা হয়েছে। সামনে অর্থনীতির যে দিকেই গতি হোক না কেন, সেটার প্রতিফলন ভবিষ্যতের প্রতিবেদনে উঠে আসবে।