সোনার দামের উত্থান নিয়ে জুয়েলার্সের সতর্কবার্তা

প্রতিবেদক: সোনা সব সময়ই দামি ধাতু। তবে বৈশ্বিক অস্থিরতার সুযোগে এর মূল্য অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। প্রায় ২৬ মাসের ব্যবধানে সোনার দাম দ্বিগুণ হয়ে এখন প্রতি ভরিতে দুই লাখ টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে। দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই, বরং আরও বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বৈধ পথে সোনা আমদানি না হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে দেশীয় বাজারেও। বর্তমানে সোনার বৈশ্বিক দর ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, যেখানে প্রতি আউন্সের (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) দাম প্রায় চার হাজার ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছরের মধ্যে এটি ৪ হাজার ৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে।

দেশের জুয়েলার্স ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশেও তার প্রভাব পড়ে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এখন সাধারণ মানুষের পক্ষে সোনা কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে শুধু ধনী শ্রেণিই এখন অলংকার ক্রয়ে সক্ষম। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো অল্প সময়ের জন্য কিছু অর্ডার পেলেও ছোট ও মাঝারি দোকানগুলো ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক ভরি সোনার দাম ছিল মাত্র ১৭০ টাকা। ১৯৮০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৭৫০ টাকা। ২০০০ সালে ভরি প্রতি দাম ছিল ৬,৯০০ টাকা, আর ২০১০ সালে তা পৌঁছে যায় ৪২,১৬৫ টাকায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো সোনার ভরি হয় ৫০ হাজার টাকা, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে এক লাখ টাকা, এবং মাত্র ২৬ মাসের ব্যবধানে ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ টাকারও বেশি।

সোনার দাম বাড়লে নতুন অলংকার কেনা ব্যয়বহুল হয়, তবে পুরনো গয়নার দাম বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, দুই বছর আগে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনা ১ লাখ ৭৭৭ টাকায় কিনে থাকলে, এখন সেটি বিক্রি করলে পাওয়া যাবে প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ ভরিতে মুনাফা প্রায় ৬৫ হাজার টাকার মতো। তবে বিক্রির সময় ওজন থেকে গড়ে ১৭ শতাংশ বাদ দিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়।

পুরনো গয়না বিক্রির এখনই কি উপযুক্ত সময়—এমন প্রশ্নের উত্তরে জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, “সোনার দাম এখনও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বৈশ্বিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে এটি আরও উঁচুতে উঠবে। তাই এখন বিক্রি না করে সংরক্ষণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তার সঙ্গে সোনার দামের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতি অস্থির হলে দেশগুলো নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার দিকে ঝোঁকে। করোনার সময় ২০২০ সালের আগস্টে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ২,০৭০ ডলার; এখন তা প্রায় ৪,০০০ ডলারে পৌঁছেছে।

রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, মার্কিন সুদহার কমার আশঙ্কা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ধারাবাহিক সোনা ক্রয়ের কারণে বিশ্ববাজারে সোনার দাম চলতি বছরই ৫১ শতাংশ বেড়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৪,৯০০ ডলারে পৌঁছাতে পারে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যদি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আরও এক হাজার ডলার বাড়ে, তাহলে দেশে সোনার ভরি সোয়া দুই লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ বৈধ পথে আমদানি না থাকায় স্থানীয় বাজারে দাম সব সময়ই বৈশ্বিক বাজারের চেয়ে কয়েক হাজার টাকা বেশি।”

বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ হাজার জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ভেনাস, আমিন, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড, আপন ও সুলতানা জুয়েলার্সের মতো ব্র্যান্ড কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো কঠিন সংকটে রয়েছে।

জুয়েলার্স সমিতির সাবেক সভাপতি এনামুল হক বলেন, “সোনার দাম যতই বাড়ুক না কেন, উচ্চবিত্ত শ্রেণি এটি কিনবেই। ফলে শিল্প ধ্বংস হবে না। বরং কম আয়ের মানুষদের জন্য ১৮ ক্যারেটের গয়নার প্রবণতা বাড়বে।”

তিনি আরও বলেন, “যেভাবে সোনা দ্রুত মূল্যবান হয়ে উঠছে, এটি এখন বিনিয়োগের জন্যও আকর্ষণীয়। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়, তাহলে ব্যাংকের মাধ্যমে সোনা কেনাবেচার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ যেমন উপকৃত হবে, তেমনি জুয়েলারি শিল্পও লাভবান হবে।”