
প্রতিবেদক: স্মল ইজ বিউটিফুল’—অর্থাৎ ছোটই সুন্দর—এই দর্শন অর্থনীতিতে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ আরনেস্ট ফ্রেডারিক সুমাখার। তাঁর মতে, বিশাল বাজেট, বড় বড় প্রকল্প কিংবা বড় কোম্পানি নয়, উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণ। ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ যেন সেই ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’-এর আদর্শেই ফিরে গেলেন। ছোট আকারের বাজেট, সীমিত বক্তৃতা, সংক্ষিপ্ত প্রতিশ্রুতি—সবকিছুতেই ছিল সংযমের ছাপ। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই ছোট বাজেট কি মানুষকে স্বস্তি দিতে পারবে? আয় কমা, কর্মসংস্থান হ্রাস, দারিদ্র্য বাড়া—এসবের কোনো কার্যকর সমাধান কি এতে আছে?
অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই এটিকে ব্যতিক্রমধর্মী বলে উল্লেখ করেন। এটি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিগত বছরের তুলনায় আকারে ছোট বাজেট। তিনি বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে সরে এসে সামগ্রিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই ভৌত অবকাঠামোর কথা না বলে বরং মানুষের দিকে বাজেটের ফোকাস রাখা হয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তার প্রতিফলন খুব বেশি দেখা যায়নি। একমাত্র উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব হলো নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল। কিন্তু ব্যক্তি বিনিয়োগ না বাড়লে সামগ্রিক স্থবির অর্থনীতিতে গতি ফেরানো কঠিনই থেকে যাবে।
ব্যাংক খাতের দুরবস্থা, যেমন উচ্চ খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি ও সুশাসনের অভাব, বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড় বাধা হয়ে আছে। অন্যদিকে সরকার নিজেও বিনিয়োগে অতি সতর্ক। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি, উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড়ের ধীরগতি ও কৃচ্ছ্রনীতি—সব মিলিয়ে একটি সংযত ও রক্ষণশীল বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, ব্যয় ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা এবং বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকেই ধার নেওয়ার লক্ষ্য ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা।
বাজেটের ব্যতিক্রম হিসেবে আরও দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। এক, এটি সংসদের বাইরে পেশ করা হয়েছে, যা ১৭ বছর পর ঘটল। দুই, অর্থ উপদেষ্টা আগের ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে এসে বাজেটের আকার সামান্য কমিয়েছেন। এভাবে প্রতি বছর বাজেট বাড়ানোর প্রতিযোগিতা থেকে সরে এসেছেন তিনি।
যদিও মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে—ডিসেম্বরের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে এপ্রিলে ৯.১৭ শতাংশে নেমেছে—তবু সাধারণ মানুষের জন্য বাস্তব স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়নি। আয়কর সীমা অপরিবর্তিত রেখেছেন, করদাতাদের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই। তবে সরকারি কর্মচারীদের জন্য সুবিধা কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না এনে পরোক্ষ কর নির্ভরতা আগের মতোই রয়ে গেছে। অনলাইনে বিক্রির ওপর ভ্যাট বাড়ানো বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সম্পূরক শুল্ক চাপানো নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
বাজেটে আবারও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক জমায় কর অব্যাহতি, সঞ্চয়পত্রে টিআইএন শর্ত তুলে দেওয়া, শিল্প কাঁচামালে আগাম কর কমানো, বাণিজ্যিক আমদানিতে কর বাড়ানো—এসব কিছু অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহ সহজ করতে সহায়ক হলেও তাতে কাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছতা আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
নতুন ঘোষণার মধ্যে আছে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা তহবিল, স্টার্টআপের জন্য ১০০ কোটি টাকা, তারুণ্যের উৎসব উদ্যাপনে আরও ১০০ কোটি টাকা এবং পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা। তবে এসব বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা বড় প্রশ্ন হয়ে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার অংশ হিসেবে শতাধিক পণ্যে শুল্ক হ্রাস বা প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা দিয়ে ওয়াশিংটনকে পুরোপুরি সন্তুষ্ট করা যাবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান।
বাজেটে আগামী বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশ হবে বলা হলেও, যে প্রেক্ষাপটে বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, সেখানে এমন প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতির চাপ, চাকরির সংকট, নিরাপত্তার অভাব—মানুষ এখন এসব বাস্তব সমস্যার সমাধান চায়। এই প্রত্যাশা থেকেই তাদের অংশগ্রহণ ঘটে গত জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে।
সবশেষে অর্থ উপদেষ্টাও বাজেট বক্তৃতার শেষ অংশে স্বীকার করেছেন, সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে এখনো অনেক পথ বাকি। নতুন মুদ্রা বিনিময় হার বা যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তেই পারে। ঝুঁকি থাকবে, তবে মানুষ তো বছরের পর বছর ধরে কষ্টই করে যাচ্ছে। এখন তারা শুধু একটু স্বস্তি চায়, কর্মসংস্থান চায়, স্থিতিশীলতা চায়। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা দিয়ে শেষ করা যায়, যেখানে তিনি আশার কথা বলেছেন—“আশা হচ্ছে পালকওয়ালা পাখি, / যা আত্মার মধ্যে বাস করে, / শব্দহীন গান গায়, / আর থামে না কোনো দিন।”