হারিয়ে যাচ্ছে শতবর্ষের তাঁত ঐতিহ্য

প্রতিবেদক: যশোর সদর উপজেলার তেঘরিয়া গ্রামের জামশেদ আলী অন্তত ৫০ বছর ধরে হস্তচালিত তাঁতে (হ্যান্ডলুম) শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও তোয়ালে বুনছেন। তাঁর বাবা, দাদা ও পূর্বপুরুষরাও একই পেশায় যুক্ত ছিলেন। বংশপরম্পরায় তাঁদের কাপড় বোনার ইতিহাস শত বছরের বেশি। তবে বর্তমানে পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের কেউ আর এই পেশায় আসছেন না। প্রধান কারণ—আয়ের অভাব ও অনাগ্রহ।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, কাঁচামালের উচ্চমূল্য ও বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় তেঘরিয়ার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় কারিগরদের মতে, এই অবক্ষয়ের প্রধান তিনটি কারণ হলো: সুতা, রং ও রাসায়নিকসহ কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, পাওয়ারলুমের তুলনায় হ্যান্ডলুমে উৎপাদন খরচ বেশি,হ্যান্ডলুম থেকে পাওয়ারলুমে যেতে প্রয়োজনীয় পুঁজি না থাকা।

এর ফলে শত বছরের এই পেশা টিকিয়ে রাখতে আগ্রহ হারাচ্ছেন নতুন প্রজন্ম। তবে অনেক কারিগর এখনো আশা করছেন, সরকারি সহায়তা পেলে তাঁতশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

যশোর জেলা তাঁত বোর্ড ও মমিননগর শিল্প সমবায় ইউনিয়ন সূত্রে জানা গেছে, ৫০ বছর আগেও এই অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরে হ্যান্ডলুম ছিল। একসময় কয়েক হাজার তাঁত থাকলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭০টিতে। তাঁতশিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই ঐতিহ্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাঁদের দাবি, কারিগরদের প্রশিক্ষণ, স্বল্প সুদে ঋণ ও পাওয়ারলুম স্থাপনে সহায়তা জরুরি।

জেলা তাঁত বোর্ডের তথ্যমতে, বর্তমানে যশোরে ২১টি পাওয়ারলুম রয়েছে। সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামে পাঁচটি পাওয়ারলুমের মধ্যে তিনটি সচল রয়েছে। একই পরিবারের তিন ভাই—মাসুদ রানা, মতিয়ার রহমান ও ফিরোজ রানা—তাঁদের পূর্বপুরুষের পেশাকে ধরে রেখেছেন।

রঘুরামপুরে গিয়ে দেখা যায়, ফিরোজ রানা পাওয়ারলুমে তোয়ালে বুনছেন। তিনি জানান, তিনি যশোর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের টেক্সটাইল বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে না গিয়ে বাবার পেশায় যুক্ত হয়েছেন। একেকটি পাওয়ারলুমে প্রতিদিন ১৮–২০টি তোয়ালে তৈরি হয়, যা ১৩৫ টাকা দরে মমিননগর শিল্প সমবায় ইউনিয়ন কিনে নেয়। ফলে বিক্রির আলাদা চিন্তা থাকে না।

রঘুরামপুরের পাশের তেঘরিয়া গ্রাম একসময় ছিল তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানে অন্তত ৪০০ পরিবারের তাঁত ছিল। এখন কেবল জামশেদ আলীর পরিবার এই পেশায় টিকে আছে। তাঁর বাড়ির উঠোনে একচালা ঘরে চারটি হ্যান্ডলুমে কয়েকজন কারিগর গামছা বোনেন।

জামশেদ বলেন, “আমি ৫০ বছর ধরে তাঁতে লুঙ্গি–গামছা বুনছি। বাবা-বাপদাদারাও এই কাজ করেছেন। কিন্তু এখন আমার ছেলেরা আর এই পেশায় আসতে চায় না। শ্রমের তুলনায় আয় কম হওয়ায় সবাই অন্য পেশায় চলে গেছে।”

তিনি আরও জানান, ‘সুতা নলি করার মতো দক্ষ কারিগর এখন দুইজন বয়স্ক মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁরা চলে গেলে এই কাজও বন্ধ হয়ে যাবে।

ঢাকার আহমদ পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত ‘জসরের ইতিহাস প্রসঙ্গ’ গ্রন্থ অনুযায়ী, কেশবপুরের মধ্যকূল গ্রামে প্রতি শুক্রবার কাপড়ের বড় পাইকারি হাট বসত। সেখানে একসময়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকার দেশি তাঁতের কাপড় বিক্রি হতো। কলকাতা থেকে সুতা এনে স্থানীয় তাঁতিরা কাপড় বুনতেন, আর হাওড়া ও চেতলায় বিক্রি হতো সেসব কাপড়। তখন গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই তাঁত বা চরকা ছিল, এবং নারীরাই ছিলেন প্রধান শক্তি।

মমিননগর শিল্প সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের সাতটি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। যশোর সদরে পাঁচটি এবং অভয়নগর ও নড়াইলে একটি করে। তাঁতিদের থেকে কাপড় কিনে এ সব কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়।

ইউনিয়নের সভাপতি লোকমান হোসেন বলেন, “আমি নিজেও হ্যান্ডলুমে লুঙ্গি বুনতাম। দিনে তিনটা লুঙ্গি বানিয়ে আয় হতো মাত্র ২৪০ টাকা। এত কম আয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাঁতশিল্প বাঁচাতে পাওয়ারলুম স্থাপন জরুরি, কিন্তু কারিগরদের পুঁজি নেই।

তিনি জানান, ২০ বছর আগেও যশোরে কয়েক হাজার তাঁত ছিল। লাখো মানুষ এই পেশায় ছিল। এখন সে অবস্থা নেই। তাঁর দাবি, সরকার সহজ শর্তে ঋণ ও প্রণোদনা দিলে নতুন উদ্যোক্তা আসবেন।

যশোর জেলা তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা আম্বিয়া আক্তার বলেন, ‘তাঁতশিল্প রক্ষায় আমরা বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিয়েছি। কাঁচামাল, সুতা, রং ও রাসায়নিক সহজলভ্য করা হচ্ছে। কখনো বিনা মূল্যে, কখনো স্বল্প মূল্যে সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি হ্যান্ডলুম কারিগরদের পাওয়ারলুমের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যেন তাঁরা নতুন উদ্যোক্তা হতে পারেন বা কারিগর হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।’