
প্রতিবেদক: আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরে সরকারি বিভিন্ন সেবা নিতে জনগণকে বাড়তি খরচ করতে হতে পারে। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার বাজেটে বিভিন্ন ধরনের মাশুল, সুদ, মুনাফা, স্ট্যাম্প বিক্রি, টোল, ইজারা, ভাড়া ইত্যাদির হার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এসব বাড়তি আয় আসবে কর ছাড়া সরকারের যে রাজস্ব খাত রয়েছে, যাকে বলা হয় নন-ট্যাক্স রেভিনিউ । এটি করভিত্তিক নয়, তবে রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
বর্তমানে সরকারের প্রধান তিনটি রাজস্ব উৎস হলো আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) এবং শুল্ক। এগুলোর দেখভাল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে এনটিআর খাতটি এনবিআরের আওতার বাইরে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এনটিআর থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের জন্য এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, সেবা সংক্রান্ত মাশুল তিন বছর পরপর কিংবা প্রয়োজন অনুসারে হালনাগাদ করতে হবে। তবে সেটি করতে হবে সেবার প্রকৃত খরচ, জীবনযাত্রার মান, মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় রেখে। যদিও বাজেট বক্তৃতায় মাশুল বৃদ্ধির বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হবে না বলে জানা গেছে।
আগামী বাজেটে হাটবাজারের ইজারা মূল্য, মোবাইল কোর্টের জরিমানা, এক্সপ্রেসওয়ে ও উড়ালসড়ক পারাপারের টোলসহ বিভিন্ন সেবা ও প্রশাসনিক মাশুল কিছুটা বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সরকার রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আদায়ের হার ৮ শতাংশের নিচে। আইএমএফের ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে, প্রতিবছর জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আদায়ের হার অন্তত ০.৫ শতাংশ বাড়াতে হবে।
অর্থ বিভাগ মনে করে, এনটিআর থেকে সরকার যথেষ্ট রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। বিভিন্ন সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং অনাগ্রহই এর প্রধান কারণ। তারা চায় শুধু বরাদ্দ, কিন্তু রাজস্ব আয়ের বিষয়ে দায়িত্বশীল নয়। যেমন, কাঁচা পাট ও পাটপণ্যের ওপর ৩০ বছর আগে ধার্য সামান্য একটি রাজস্ব মাশুল বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিজেই তা প্রত্যাহারের আবেদন জানায়।
এনটিআর খাতের মধ্যে বড় রাজস্ব উৎসগুলোর একটি হচ্ছে লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সরকারি বিনিয়োগ থেকে সরকার এই আয় পেয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ৭ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা আয় নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও আগের বছর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। সরকারি কর্মচারী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ থেকে ৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, যা আগামী অর্থবছরে আরও বাড়ানো হবে।
আইনভঙ্গ, জরিমানা ও বাজেয়াপ্তকরণ থেকেও সরকার আয় করে। চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে ৬৪৩ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও, আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে।
সরকার বিভিন্ন সেবা থেকে যেমন আমদানি-রপ্তানি সনদ, কোম্পানি নিবন্ধন, বিমা প্রিমিয়াম, সমবায় নিরীক্ষা ও নিবন্ধন ইত্যাদি থেকেও আয় করে। এসব মাশুল বৃদ্ধির মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি হাট-ঘাটের ইজারা, টোল ও লেভি থেকে আরও হাজার কোটি টাকা এবং পুরোনো গাড়ি ও আসবাব নিলামে বিক্রি করে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে।
সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “সামান্য কিছু মাশুল বাড়ালেই সমালোচনা হয়। অথচ অর্থনীতি বড় হচ্ছে, সরকারকেও তো চলতে হবে। সরকার সংগৃহীত অর্থ জনগণের জন্যই ব্যয় করে।” তিনি আরও বলেন, “এনবিআরের বাইরে থেকেও রাজস্ব আদায়ের সুযোগ রয়েছে, আর এনটিআর খাতকে গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।”