
প্রতিবেদক: আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে করের চাপ কমানোর দাবি জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁদের মতে, করজাল সম্প্রসারিত না হওয়ায় যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপরই বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় প্রকৃত করহারের চেয়েও বেশি কর দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তাদের হয়রানি বন্ধেরও দাবি ওঠে।
গতকাল বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এনবিআরের পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সভায় প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী নেতা বাজেট সংক্রান্ত নানা প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর দাবি জানান। তিনি প্রস্তাব করেন, সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য ৫ লাখ টাকা করা হোক। মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এই সীমা বাড়ানো জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতা কর কাঠামো সহজ করার পাশাপাশি উৎসে কর ০.৫০ শতাংশ নির্ধারণ, আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ধাপে ধাপে কমানো, স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যে মূসক ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং এইচএস কোড ভুলের কারণে আরোপিত জরিমানা বাতিলের প্রস্তাব দেন।
এদিকে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান স্পষ্টভাবে জানান, করহার কমানোর সুযোগ আপাতত নেই। তবে তিনি আশ্বাস দেন, কর আদায়ের প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ীদের যেন ভোগান্তি না হয়, সে চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, “সব দাবি মানা সম্ভব নয়, কারণ সরকারের রাজস্ব আয় নিশ্চিত করতেই হবে।”
মেট্রোপলিটন চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, দেশে ১ কোটি ১৪ লাখ কর শনাক্ত নম্বরধারী (টিআইএনধারী) থাকলেও মাত্র ৪৫ লাখ রিটার্ন জমা দেন, যার দুই-তৃতীয়াংশই শূন্য রিটার্ন। ফলে করজাল সম্প্রসারণ না করে যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের ওপরই বারবার চাপ পড়ছে।
ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি রাজীব চৌধুরী বলেন, দেশের মোট রাজস্ব আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। অথচ অনানুষ্ঠানিক খাত, যার অবদান প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ, সেখানে কর আদায়ের তেমন উদ্যোগ নেই।
রাঙামাটি চেম্বারের প্রতিনিধি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া পার্বত্য তিন জেলায় কর অঞ্চল স্থাপনের দাবি জানান। তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে করভীতি দূর করতে হবে, যাতে স্বেচ্ছায় কর দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল অভিযোগ করেন, কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেও গত দুই বছর ধরে গ্যাস-বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের কথা বলা হলেও স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাই জ্বালানি সংকটে ভুগছেন।”
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ীর ব্যাংক হিসাব ও করনথি তল্লাশি করা হচ্ছে। এসব হয়রানি বন্ধে তিনি এনবিআরের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সিরামিক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি সিরামিক খাতের জন্য হুমকি। আমদানি করা কাঁচামালে পানি থাকলেও তা বাদ দিয়ে শুল্ক নির্ধারণ করা হলে শিল্পে স্বস্তি আসবে।
রিহ্যাব পরিচালক আইয়ুব আলী ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফি ১৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ শতাংশ করার দাবি জানান। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, জমি ও ফ্ল্যাটের প্রকৃত মূল্যায়ন নিশ্চিত করা গেলে ফি কমিয়েও রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম কাস্টমসের অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে বলেন, স্ক্র্যাপ আমদানিতে অপ্রয়োজনীয় হয়রানির কারণে সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, ব্যবসায়ীরা করবান্ধব ও হয়রানিমুক্ত বাজেট প্রণয়নের দাবি জানিয়ে এনবিআরের সঙ্গে কার্যকর সংলাপের ওপর গুরুত্ব দেন।