
প্রতিবেদক: আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ব্যাংক খাতের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এর লক্ষ্য শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নয়, আর্থিক সংকটে পড়া কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়া। এ উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গত ৯ মে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ক্ষমতা। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তাঁর প্রথম বাজেটে এই কাজগুলো পরিচালনার জন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ রাখছেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও সহায়তা নেওয়ার উদ্যোগ রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে বাজেট থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এভাবে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় মূলধন ঘাটতি, প্রভিশন ঘাটতি পূরণ এবং ব্যাংক পুনর্গঠনের নামে। যদিও শেষের দিকে এই ধরনের বরাদ্দ বন্ধ করা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার আবার তা ফিরিয়ে আনছে। নতুন উদ্যোগের আওতায় সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে ইসলামি ধারাসহ যেকোনো তফসিলি ব্যাংককে সাময়িকভাবে সরকারি মালিকানায় নেওয়ার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দেখে, কোনো ব্যাংক কার্যকর নয়, দেউলিয়া হয়ে গেছে বা আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে অক্ষম—তবে তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৫–২৬ অর্থবছর থেকেই এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। এ ব্যবস্থার প্রয়োগ এবং ব্যাংক পুনর্গঠনের জন্যই বাজেটে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেছেন, কয়েকটি ব্যাংকের দুরবস্থা বিবেচনায় তাদের সাময়িকভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা একটি যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ। এতে করে জনগণের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরবে। তবে এসব উদ্যোগ যেন সুশাসনের মধ্যে সম্পন্ন হয়, সেটাও জরুরি।
একই সঙ্গে ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, আগে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হতো মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য, আর এবার তা ব্যাংক পুনর্গঠনের জন্য। তিনি আরও বলেন, আমানতকারীদের অধিকার যেন খর্ব না হয় এবং তারা যেন নিরাপদে অর্থ ফেরত পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানির অবস্থাও সংকটপূর্ণ—সেগুলোর প্রতিও সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে ২,৬০০ কোটি, বেসিক ব্যাংকে ৪,৫০০ কোটি এবং জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ কেলেঙ্কারিতে ১,২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়। এসব ঘটনায় ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দিলে সরকার বাজেট থেকে অর্থ দিয়ে তাদের সহায়তা করে। সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ফারমার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) পর্যন্ত সরকারি সহায়তা পায়।
বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এই ধরনের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০০৫–০৬ অর্থবছরে সোনালী ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও রাকাবকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭–০৮ অর্থবছরে এসব ব্যাংককে অর্থ সহায়তা দেয়। এমনকি ২০০৮–০৯ অর্থবছরে, যা আংশিক সময় তত্ত্বাবধায়ক এবং আংশিক সময় মহাজোট সরকারের অধীনে ছিল, তখনো কৃষি ব্যাংক ও রাকাবকে যথাক্রমে ৫৫০ কোটি ও ৩৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়।
সার্বিকভাবে এই বরাদ্দের উদ্দেশ্য হলো ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তবে এই প্রক্রিয়া যেন যথাযথ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্যে সম্পন্ন হয়, সেটিই এখন সবার প্রত্যাশা।