
প্রতিবেদক: বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজারের আকার ৩ লাখ কোটি ডলারের বেশি হলেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মাত্র ৮৫ কোটি ডলারের মতো হালাল পণ্য রপ্তানি করছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষিভিত্তিক পণ্যের পাশাপাশি হালাল ফার্মাসিউটিক্যালস, কসমেটিকস ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে একক হালাল সার্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষ গঠন ও প্রযুক্তিনির্ভর মাননিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা জরুরি।
শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) কার্যালয়ে ‘হালাল শিল্প খাতের উন্নয়ন: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক ফোকাস গ্রুপ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, দেশে বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) আলাদাভাবে হালাল সনদ প্রদান করে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখন পর্যন্ত ২৫৪টি কোম্পানি ও বিএসটিআই ২৩টি কোম্পানিকে সনদ দিয়েছে। একই খাতে দুটি প্রতিষ্ঠান থাকার কারণে সনদপ্রদান প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি হচ্ছে।
মূল প্রবন্ধে আইইউবিএটির সহকারী অধ্যাপক মমিনুল ইসলাম বলেন, হালাল বাজার ধরার পথে বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার কম, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিংয়ে পিছিয়ে থাকা, এসএমই উদ্যোক্তাদের অনুপস্থিতি, সমন্বিত নীতিমালার অভাব, দক্ষ জনবল সংকট, দুর্বল ট্রেসেবিলিটি ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাস্তবায়নে অসংগতি—এসব সমস্যা অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি জাতীয় সমন্বিত হালাল বোর্ড গঠনের পরামর্শ দেন।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআইয়ের ঊর্ধ্বতন সহসভাপতি রাজীব এইচ চৌধুরী বলেন, বৈশ্বিক হালাল পণ্যের বাজারের আকার বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ কোটি ডলার, যা ২০৩৪ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ কোটি ডলারে উন্নীত হতে পারে। অথচ বাংলাদেশ মাত্র ৮৫ কোটি ডলারের মতো হালাল পণ্য রপ্তানি করছে, যার বেশিরভাগই কৃষিভিত্তিক। তিনি বলেন, বিএসটিআই ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্রুত একটি স্বীকৃত জাতীয় হালাল সার্টিফিকেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
আলোচনা পর্বে ব্যবসায়ীরা হালাল রপ্তানিতে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেন। প্যারাগন গ্রুপের রপ্তানি বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিদেশি ক্রেতারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হালাল সনদ চায়, যেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। বেঙ্গল মিটের রপ্তানি ও সাপ্লাই চেইন বিভাগের প্রধান সায়েদুল হক ভূঁইয়া বলেন, শুধু হালাল জবাই নয়, পশুর খাবার, ফার্ম, ভ্যাকসিনেশন পর্যন্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পণ্যে মূল্য সংযোজন বাড়াতে বড় বিনিয়োগ ও সরকারি নীতিসহায়তা প্রয়োজন।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মেটামরফোসিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিক এম আলম মনে করেন, কাঁচামাল থেকে ভোক্তার হাতে প্রস্তুত পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে হালাল প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির বিকল্প নেই। তিনি বলেন, একটি জাতীয় হালাল রেজিস্ট্রি করা জরুরি, যার মাধ্যমে ব্লকচেইনভিত্তিক অনলাইন সার্টিফিকেশন দেওয়া সম্ভব হবে।
সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরাও এ খাতের সম্ভাবনা ও করণীয় নিয়ে মত দেন। বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডের মহাপরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, সমন্বিত প্রয়াস বাস্তবায়ন হলে বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক বেবী রানী কর্মকার জানান, বিশ্বে হালাল বাজার প্রতিবছর প্রায় ১২ দশমিক ৮ শতাংশ হারে বাড়ছে, তাই দেশের অংশগ্রহণ বাড়াতে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক আরিফুল হক বলেন, হালাল পণ্যের সনদ ও মান নিশ্চিত করতে একটি একক কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন, এ বিষয়ে কাজ চলছে। পাশাপাশি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করার সম্ভাবনাও বিবেচনায় আছে। বিএসটিআইয়ের উপপরিচালক এ এম আবু সাঈদ বলেন, একই উৎপাদন লাইনে সাধারণ পণ্যের সঙ্গে হালাল পণ্য তৈরি গ্রহণযোগ্য নয়, এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার এবং একীভূত কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে কার্যকর হবে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগের উপপরিচালক মো. আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলেন, হালাল পণ্য নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান আলাদাভাবে কাজ করায় সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। তিনি জানান, এখনো দেশে কোনো সরকারি মানসম্পন্ন ট্রেসেবিলিটি-সমর্থিত জবাইখানা নেই। বিদেশি প্রতিনিধি এলে তাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল মিটের কারখানায় নিয়ে যেতে হয়। পশ্চাৎ সংযোগ ও অবকাঠামো শক্তিশালী না হলে শুধু সনদ দিয়ে সফলতা পাওয়া সম্ভব নয়।