৮৩% খেলাপি ঋণ, চরম সংকটে ২০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের ২০টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে পারছে না এবং দীর্ঘদিন ধরে তারা তারল্য সংকটে ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছে, কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না। ১৫ দিনের মধ্যে তাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে ৩৫টি এনবিএফআই রয়েছে, যার মধ্যে বেশির ভাগই দেশীয় মালিকানাধীন এবং অল্প কয়েকটি বাদে প্রায় সবগুলোই আর্থিক সংকটে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান নানা নামে ঋণ বিতরণ করলেও তার যথাযথ আদায় হচ্ছে না। ফলে তারা আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এর ফলে এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের চিহ্নিত ২০টি দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো: সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, হজ্জ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স।

এই সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ হলো পি কে হালদারের দুর্নীতি। তার মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় থাকা একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও পিপলস লিজিং এর মতো প্রতিষ্ঠান কার্যত দেউলিয়া হয়ে গেছে। শত শত গ্রাহক তাদের আমানতের টাকা ফেরত পাননি। পি কে হালদার একসময় এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত একটি ব্যাংকের এমডি ছিলেন। তার পরবর্তী সময়েও এনবিএফআই ও ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোতেও অনিয়ম বিস্তৃত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এনবিএফআই খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩.২৫ শতাংশ। যদিও সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩৫.৫২ শতাংশ, সেখানে ডিসেম্বরে কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৩৩.২৫ শতাংশ হয়েছে। এক প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমেছে প্রায় এক হাজার ৭৪ কোটি টাকা।

এনবিএফআইগুলোর দুরবস্থার চিত্র আরও ভয়াবহ। ২০টি দুর্বল প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৮৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ডিসেম্বর শেষে এই ২০টি প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা, যার বিপরীতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে। জামানতের পরিমাণ মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, যা দিয়ে কেবল ব্যক্তি আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা ভালো অবস্থানে থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এতে পুরো খাতের ওপর আস্থা হারাচ্ছে জনগণ। চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক বেতন ব্যয় প্রায় ২০৬ কোটি টাকা হলেও তাদের প্রকৃত কোনো সুদ আয় নেই। সেজন্য আইন অনুযায়ী পুনর্গঠন ও একত্রীকরণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানে মূলধন ঘাটতি, শ্রেণীকৃত ঋণের উচ্চহার, সম্পদের অপর্যাপ্ততা ও আমানত পরিশোধে ব্যর্থতার মতো গুরুতর অনিয়ম দেখা গেছে। তাই আইন অনুযায়ী কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান মো. গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া জানান, অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনঃতফসিল ও আদায় কার্যক্রম জোরদার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তদারকি বৃদ্ধি করেছে। করপোরেট গভার্ন্যান্স উন্নয়ন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির ফলে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এখনো খেলাপি ঋণের হার এক-তৃতীয়াংশের বেশি, যা উদ্বেগজনক। এর সমাধানে ঋণ আদায়ে আইনি কার্যক্রম জোরদার, বিতরণে স্বচ্ছতা এবং পরিচালনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, সব এনবিএফআই দুর্বল নয়। কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। কিন্তু সার্বিকভাবে এই খাতকে পুনর্গঠন করতে হবে এবং ব্যাংকের মতো এনবিএফআইগুলোকেও ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অ্যাক্ট’ ও ‘প্রম্পট করেক্টিভ অ্যাকশন ফ্রেমওয়ার্ক’-এর আওতায় আনতে হবে।