৮৬২ কোটি টাকা গ্যাস বিল বকেয়া: সরকারের নীরবতায় মেঘনা গ্রুপের ‘ছাড়’

প্রতিবেদক: মেঘনা গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৮৬২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির। বছরের পর বছর ধরে এই বিপুল অর্থ বকেয়া রেখে যাচ্ছে মেঘনা গ্রুপ, অথচ এতদিন কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করেনি। তিতাসের যেসব কর্মকর্তা বিল আদায়ের চেষ্টা করেছেন, তাদের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা গেছে, মেঘনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এভারেস্ট পাওয়ার লিমিটেডের কাছে ৭৭০ কোটি এবং মেঘনা সুগার রিফাইনারির কাছে ৯২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। একাধিকবার চিঠি দিয়েও এসব পাওনা আদায় করতে পারেনি তিতাস।

এভারেস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (ক্যাপটিভ হিসেবে) ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে। গ্যাস সংযোগের অনুমোদনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল বলে জানা গেছে। এমনকি কেন্দ্রটির উদ্বোধনও করেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই। এই ঘনিষ্ঠতার ফলে মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল সব ধরনের নিয়মের ঊর্ধ্বে উঠে যান বলে অভিযোগ।

শুরুতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ২৫ মেগাওয়াট, যা ২০১৪ সালে বাড়িয়ে ৫০.৭০ মেগাওয়াট করা হয়। এরপর এটি ক্যাপটিভ থেকে স্মল আইপিপি হিসেবে রূপান্তরিত হয়। উৎপাদিত বিদ্যুৎ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও মেঘনা ইকোনমিক জোনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়।

তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নির্দেশনা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ বিক্রির দুই অংশের গ্যাস বিল আলাদা রেটে পরিশোধের কথা থাকলেও, কোম্পানিটি নিয়ম ভেঙে শুধুমাত্র ক্যাপটিভ রেটে বিল প্রদান করছে।

তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ জানান, মেঘনা গ্রুপের এ ধরনের আচরণ খুবই দুঃখজনক। তারা বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। তবে এখন প্রতিষ্ঠানটি ‘হার্ডলাইনে’ যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এদিকে, মেঘনা গ্রুপের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারের অভিযোগ। আওয়ামী লীগ সরকারঘনিষ্ঠ এই গ্রুপটি ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন পণ্যে সিন্ডিকেট গড়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও, এতদিন সরকার ছিল নীরব দর্শক।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, মেঘনা গ্রুপের কর্ণধার মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে ৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের অভিযোগে তদন্ত চলছে। গত ৮ এপ্রিল এ সংক্রান্ত চিঠি দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে দুদক।

এর আগে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ মোস্তফা কামাল, তার স্ত্রী বিউটি আক্তার এবং তাদের সন্তানদের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়। তাদের একক মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের হিসাবও জব্দ করার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া মেঘনা গ্রুপের ৫৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৬,৭৬৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। শুধু মেঘনা সুগার রিফাইনারির নামে নেওয়া ঋণই ৩,০১৮ কোটি টাকা, যার বড় একটি অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা।

একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আমদানিতে ৭৯,৭৬২ কোটি টাকার আন্ডার ইনভয়েসিং করেছে মেঘনা গ্রুপ। এছাড়া বীমা, ভ্যাট, স্ট্যাম্প ডিউটি এবং ব্যাংক কমিশন মিলিয়ে প্রায় আরও এক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

মেঘনা নদীর জায়গা দখল, অবৈধ নদী ভরাট, অন্যের জমি দখলের মতো অভিযোগও রয়েছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) জমা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (ব্র্যান্ড) কাজী মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। ফোন রিসিভ না করলেও হোয়াটসঅ্যাপে দেওয়া মেসেজ পড়েও তিনি কোনো উত্তর দেননি।