
অনলাইন ডেক্স: দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত নানা সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে। তৈরি হচ্ছে নতুন উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও বড়লেখায় মণিপুরি তাঁতশিল্প নিয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে এমনই এক উদ্যোগ।
মল্লিকা দেববর্মা, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের পাহাড়ি অঞ্চল ডলুছড়া গ্রামের এক তরুণী। এইচএসসি পাসের পর অর্থসংকটে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ‘সবুজ ছায়া মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্প’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে জীবিকার পথ খুঁজে পেয়েছেন। একটি চাদর বুনতে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সময় লাগে, মজুরি মেলে ১৫০ টাকা। এতে পরিবারের খরচ চালাতে কিছুটা হলেও সহায়তা করতে পারেন তিনি।
কারখানায় তার সহকর্মী নম্রতা দেববর্মা। সে স্থানীয় দ্য বার্ডস রেসিডেনসিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রী। নম্রতা জানায়, দৈনিক আয়ের টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারেরও কিছুটা ব্যয় বহন করতে পারে।
তাঁতশিল্পের নতুন সম্ভাবনা
শ্রীমঙ্গল সদর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ডলুছড়া গ্রাম। চা বাগানের সবুজ টিলা ও আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের ঢালে দেখা মেলে ‘সবুজ ছায়া মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্প’ কারখানার। এখানে ১০ থেকে ১২ জন নারী তাঁতি চাদর, গামছা, শাড়ি, ওড়না ও থ্রিপিস তৈরি করছেন। তারা সবাই স্থানীয় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সদস্য।
কারখানার টিনশেড ঘরে হস্তচালিত তাঁতযন্ত্রে চলছে কর্মব্যস্ততা। কেউ চাদর বুনছেন, কেউ শাড়ি বা ওড়না। তাঁতযন্ত্রের খটখট শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে বনঘেরা পরিবেশ। এই তাঁতশিল্পের হাত ধরেই শত বছরের পুরোনো মণিপুরি তাঁতশিল্প আবারও ফিরে আসছে এবং নতুন জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করছে।
উদ্যোক্তার ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ
এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের পেছনে রয়েছেন রবিউল ইসলাম রাসেল, একজন উদ্যমী উদ্যোক্তা। দুই বছর আগে তিনি এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি জানান, অনলাইনে এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রশিক্ষণের বিজ্ঞপ্তি দেখে ঢাকায় গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর এসএমই ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় তাঁত শ্রমিকদের জন্য পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ ও এক মাসের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মশালা আয়োজন করেন।
এসএমই ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এখানে তাঁতশিল্প ক্লাস্টার গড়ে ওঠে, যা শুধু মণিপুরি তাঁতশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করেই নয়, বরং স্থানীয়দের জন্য টেকসই কর্মসংস্থানও নিশ্চিত করছে।
এই উদ্যোগ শুধু ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্যই নয়, বরং স্থানীয় নারীদের স্বাবলম্বী করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথও তৈরি করছে। তবে মজুরি বৃদ্ধি, বাজার সম্প্রসারণ ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আরও সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
উদ্যোক্তা রবিউল ইসলাম রাসেল দুই লাখ টাকায় পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেওয়া আধাপাকা ঘরে সাতটি তাঁতযন্ত্র স্থাপন করেন, প্রতিটির খরচ পড়ে ৪০ হাজার টাকা। আনুষঙ্গিক কাঁচামালসহ মোট বিনিয়োগ হয় ৭ লাখ টাকা। বর্তমানে কারখানায় উৎপাদিত তাঁতবস্ত্র ইউনিমার্ট, কেক্রাফট, এমডি বিলাসসহ বিভিন্ন শোরুম ও অনলাইন মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারাও আকৃষ্ট হচ্ছেন।
একই কারখানার তাঁতবস্ত্র কিনে অনলাইনে বিক্রি করেন মো. নোমান, যিনি একটি ব্যাংকে কর্মরত। তিনি জানান, একটি শাড়ি বিক্রিতে ২০০-৩০০ টাকা মুনাফা হয়।
শ্রীমঙ্গলের ডলুছড়া গ্রামে ৯৫টি ত্রিপুরা পরিবারের বসবাস। এখানকার নারীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোমর তাঁত ব্যবহারে দক্ষ হলেও এটি শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তাঁতযন্ত্রের সংযোজন উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে, নকশায় বৈচিত্র্য এনেছে ও কিছুটা দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাঁতি অম্বালিকা দেববর্মা বলেন, “মজুরি কম, তবে পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।” গ্রামবাসীরাও চান, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প টিকে থাকুক।
কয়েক শতাব্দীর পুরোনো মণিপুরি তাঁতশিল্প পুঁজি ও প্রশিক্ষণের অভাবে বিলুপ্তির পথে ছিল। তবে রাসেলদের মতো উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টায় এটি আবারও নতুন প্রাণ পেয়েছে, স্থানীয়দের জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে।
উদ্যোক্তারা মনে করছেন, মণিপুরি তাঁতশিল্পের আরও প্রসার ঘটাতে কিছু প্রতিবন্ধকতা দূর করা জরুরি। বস্ত্র উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল সুতা—যা ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। শহরের বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনতে প্রতি কেজির জন্য ৫৫০ টাকা গুনতে হয়, যা ব্যয়বহুল। দেশেই সুতা উৎপাদন হলে খরচ কমে যেত। এছাড়া, সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া গেলে কারখানার সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব, যা নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে।
সবুজ ছায়া মণিপুরি তাঁত হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী রবিউল ইসলাম রাসেল জানান, সব খরচ বাদ দিয়ে তাঁর বাৎসরিক আয় ৪-৫ লাখ টাকা। বর্তমানে তিনি রপ্তানির পরিকল্পনা করছেন। গত বছর এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে নেপালের এসএমই মেলায় অংশ নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে পরিচিত হন এবং ৬-৭ লাখ টাকার তাঁতপণ্য রপ্তানি করেন। রাসেলের মতে, অর্থ সংকটের কারণে কারখানা সম্প্রসারণ সম্ভব হচ্ছে না। সহজ শর্তে ও কম সুদে ঋণ পেলে তিনি কারখানা বড় করে আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
উদ্যোক্তা সালেহা বেগম বৃষ্টি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ২০১৬ সালে তাঁতশিল্পে যুক্ত হন। তাঁর কারখানায় পাটজাত পণ্য তৈরি হয়, যেখানে ২০-২৫ জন নারী শ্রমিক কাজ করেন। মুনাফা কম হলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি মনে করেন, প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা পেলে কারখানা আরও বড় করা সম্ভব।
এসএমই ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সহায়তায় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারপারসন মো. মুশফিকুর রহমান জানান, দেশে সুতা উৎপাদনের বিষয়ে প্রস্তাব পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। বাজার সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের আন্তর্জাতিক মেলায় পাঠানো হচ্ছে, যা রপ্তানির সুযোগ তৈরি করছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, চলতি অর্থবছরে ২৩টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। তাঁতশিল্পের উদ্যোক্তারাও এই ঋণ সুবিধা পাবেন, যা শিল্পের প্রসারে বড় ভূমিকা রাখবে।